যুদ্ধবিরতির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে ইসরায়েল ও হামাসের প্রতি জাতিসংঘপ্রধানের আহ্বান

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

জাতিসংঘ প্রধান গাজা উপত্যকায় যুদ্ধে ‘বর্তমান দুর্ভোগ বন্ধ করার’ লক্ষ্যে সোমবার ইসরায়েল ও হামাসকে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করার জন্য ‘আরো প্রচেষ্টা চালানোর’ আহ্বান জানিয়েছেন।

মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, গাজার দক্ষিণে জনাকীর্ণ শহর রাফাহতে ইসরায়েলি আসন্ন সামরিক অভিযানের ব্যাপারে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করার লক্ষ্যে আলোচনার আগে রাফাহতে বোমাবর্ষণ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল সোমাবার রাতে গাজার দক্ষিণের রাফাহ শহরে হামলা চালিয়েছে। হামাস অনুমোদিত যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে গতকাল মিশরে আলোচনার প্রাক্কালে হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগে ইসরায়েল এই হামলা চালায়।

ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ ধরে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ সীমান্ত শহরে সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়ার পর ইসরায়েল একটি স্থল অভিযানের লক্ষ্যে সোমবার পূর্ব রাফাহ থেকে ফিলিস্তিনিদের একটি ‘সম্প্রসারিত মানবিক এলাকায়’ চলে যাওয়ার আহ্বান জানায়। সারা রাত ভারি বোমাবর্ষণ করা হয়। ইসরায়েলি হামলায় পাঁচজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। হামাস সোমবার সন্ধ্যায় সাত মাসের চলমান যুদ্ধে তাদের ‘যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের অনুমোদন’ সম্পর্কে মধ্যস্থতাকারীদের মিশর ও কাতারকে অবহিত করার পর রাফাহতে ফিলিস্তিনি জনতা রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, প্রস্তাবটি ‘ইসরায়েলের অপরিহার্য দাবিগুলো থেকে অনেক দূরে’, তবে ‘একটি চুক্তির সম্ভাব্যতা চূড়ান্ত করতে’ সরকার আলোচনার জন্য আলোচনাকারীদের মিশর পাঠাবে।

ইসরায়েল বলেছে, ‘আমাদের জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন এগিয়ে নিতে হামাসের ওপর সামরিক চাপ দেয়ার জন্য তারা এরই মধ্যে রাফাতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।’ ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা হামাসের প্রতিক্রিয়া ‘পর্যালোচনা’ করছে।

হামাস সদস্য খলিল আল-হাইয়া কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা নিউজ চ্যানেলকে বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে তাতে তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি জড়িত।

তিনি বলেন, এর মধ্যে রয়েছে গাজা থেকে ইসরায়েলের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, যুদ্ধের ফলে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তন এবং একটি জিম্মি-বন্দি বিনিময়, যার লক্ষ্য ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’।

কাতার বলেছে, তারা আলোচনা পুনরায় শুরু করতে গত মঙ্গলবার সকালে কায়রোতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। তারা ‘আশা করছে আলোচনাটি গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হবে’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামাসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে নাকি ‘বাধা’ দেবে।

গত সোমবার রাতে পুনরায় ফিলিস্তিনিদের রাফাহ ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ‘বিমান রাফাহ এলাকায় ৫০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তকে লক্ষ্য করে দিনব্যাপী হামলা চালিয়েছে।’ হামাসের মিত্র ইসলামিক জিহাদ সোমবার রাতে বলেছে, তারা জবাবে গাজা থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করেছে। মিশরের সীমান্তে অবস্থিত রাফাহতে ইসরায়েলি স্থল আক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সতর্কতা ক্রমাগতভাবে জোরদার হচ্ছে।

মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাফায় আশ্রয় নেয়া ১০ লাখেরও বেশি গাজাবাসীর জন্য ‘গুরুতর মানবিক ঝুঁকি’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে এবং ইসরায়েলকে ‘সর্বোচ্চ সংযম অনুশীলন’ করার আহ্বান জানিয়েছে।

জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে রাফাহতে ‘নতুন গণহত্যা’ বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করতে বলেছেন। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গত সোমবার নেতানিয়াহুর সাথে কথোপকথনে বাইডেন শহরটি আক্রমণের বিরোধিতা করে ‘তার স্পষ্ট অবস্থান’ পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

নেতানিয়াহু কোনো যুদ্ধবিরতি পাত্তা না দিয়ে অবশেষে রাফাতে স্থল সেনা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, গাজায় যুদ্ধের সূত্রপাতকারী ৭ অক্টোবরের রক্তাক্ত হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হামাসের অবশিষ্ট বাহিনীকে মূলোৎপাটন করতে হবে।

হামাস পরিচালিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হামাসকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইসরায়েল গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩৪, ৭৩৫ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাফায় অভিযানের বিষয়ে নেতানিয়াহুকে আবারো সতর্ক করেছেন।

এই সতর্কতা সত্ত্বেও ইসরায়েল রাফায় অভিযান চালানোর বিষয়ে অনড় রয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, হামাস গাজায় জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র হামাসের রাজি হওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছে বলে জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের পরিচালক বিল বার্নস আরব মিত্রদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্যে মধ্যপ্রাচ্য সফর করছেন। এদিকে জো বাইডেন এপ্রিলে নেতানিয়াহুকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, রাফায় অভিযান চালানো হবে ভুল।

এছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে জেরুজালেমে বলেছেন, রাফায় আশ্রয় নেয়া ১০ লাখেরও বেশি বেসামরিক নাগরিকের কারণে সেখানে কোনো অভিযান চালানো উচিত হবে না। হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, বাইডেন সোমবার আবারো রাফা নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য কোনো মানবিক পরিকল্পনা দেখছে না।

সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, আমরা মনে করি রাফায় এ মুহুর্তে অভিযান চালালে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগকে রাতারাতি বাড়িয়ে তুলবে এবং বেসামরিক প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাবে।

কিন্তু বাইডেন ও নেতানিয়াহুর ফোনালাপের কয়েকঘণ্টা পরই ইসরায়েল রাফা থেকে ফিলিস্তিনীদের সরে যেতে দ্বিতীয় দফায় নির্দেশ জারি করে বলেছে, তারা সেখানে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এদিকে ইসরায়েল সোমবার রাতে রাফা এলাকায় বিমান হামলা জোরদার করেছে। ইসরায়েলী সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ইসরায়েলি বিমান গত সোমবার রাফায় ৫০টিরও বেশি সন্ত্রাসী স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত রাফা ক্রসিংয়ের দখল নিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। গতকাল এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে আইডিএফ। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সোমবার রাতে আইডিএফের সেনারা রাফা ক্রসিংয়ের গাজা অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই মুহূর্তে ক্রসিংয়ের যাবতীয় অপারেশনাল কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের সেনারা ক্রসিংয়ের আশেপাশে সন্ত্রাসীদের কোনো গোপন আস্তানা রয়েছে কি না, তার অনুসন্ধান করছে। এই অনুসন্ধান শুধু ক্রসিংয়ের গাজা অংশে চলছে।’

গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত রাফা ক্রসিংয়ের একপাশে গাজা, অন্য পাশে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলা এবং তার জবাবে গাজায় আইডিএফের অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত এই সীমান্তপথটিকে গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘লাইফ লাইন’ বলে বিবেচনা করা হতো। কারণ এই সীমান্তপথ দিয়েই খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর সরবরাহ প্রবেশ করত গাজায়। তবে ৭ অক্টোবরের থেকে সীমান্তপথটি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। মাঝেমধ্যে ত্রাণের গাড়ি প্রবেশের জন্য খুললেও গত ৭ মাসের অধিকাংশ সময় বন্ধই থেকেছে রাফাহ ক্রসিং। এদিকে পুরা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে রাফাহ শহরে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। অনেকে ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলাকায় তাঁবু গেঁড়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। এক মাসেরও বেশি সময় আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, রাফায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা। তবে নেতানিয়াহু এই ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পর্যন্ত একাধিকবার রাফায় সামরিক অভিযান চালানের ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে নিষেধ করেছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনী অভিযান শুরু হলে রাফায় বেসামরিক নিহতের সংখ্যা আরো বাড়বে এবং যুদ্ধে মিরে ছড়িয়ে পড়বে- এমন আশঙ্কা থেকেই এই নিষেধ করেছিলেন বাইডেন। কিন্তু নেতানিয়াহু, তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা এবং আইডিএফ সেই নিষেধে কর্ণপাত করেনি।