‘সময় গেলে সাধন হবে না’

আর কতবার মনে করিয়ে দিতে হবে পরীক্ষার্থীদের

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শেখ কুতুব আলী

বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের একটি বিখ্যাত গানের প্রথম লাইন হচ্ছে এমন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিসিএস) পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া শিক্ষক নিবন্ধন কিংবা ভর্তি পরীক্ষার দিনে প্রচুর পরীক্ষার্থীর সমাবেশ ঘটে। সাধারণ ছুটির দিন বিশেষ করে গতকাল শুক্রবার আমাদের দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশংকায় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সময় মতো পরীক্ষা শুরু করার ব্যাপারে অত্যন্ত ‘সিরিয়াস’ থাকে। আবার যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় তারাও সময় মতো পরীক্ষা শুরু করার ব্যাপারে খুবই ‘সিরিয়াস’। কোনো প্রকার সমালোচনা কিংবা বিড়ম্বনা ছাড়াই যাতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সেটা সংশ্লিষ্ট সকল মহলই কামনা করে। তবে কার্যত দেখা যায়, কোনো কোনো পরীক্ষার্থী সেভাবে বিয়ষটিতে সিরিয়াস হিসেবে নেন না। যারা সিরিয়াস হিসাবে নেন, তাদের জন্য হয়তো কোনো বিড়ম্বনা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অপেক্ষা করে না। তবে যারা পরীক্ষাকে কিছুটা অবহেলার চোখে দেখেন তাদের এ জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। চাকরি কিংবা ভর্তি পরীক্ষায় নয়, এমনকি বিসিএস পরীক্ষায় যারা অংশ নেন তাদের মধ্যে কারো কারো সময় জ্ঞানের যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। যারা এমন প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জীবনের শুরুতে প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার চাকরিতে প্রবেশ করবেন, তাদের মধ্যে সময়জ্ঞান থাকবে না, এমনটা কাম্য নয়। সময়জ্ঞানে যারা উত্তীর্ণ হতে পারেন না তারা কর্মজীবনে কীভাবে অন্যকে সময় সম্পর্কে নসিয়ত করবেন- সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের দেশে পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক কিংবা শিক্ষার্থীরা যেসব কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করেন তারা পরীক্ষার আগের দিনে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে ছুটে এমন অভিযোগ রয়েছে। পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মতো ন্যাকরজনক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে কখনো কখনো ‘ভুয়া প্রশ্নপত্র’ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা আমাদের দেশে এর আগেও ঘটেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ করে অত্যন্ত কঠোর গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর কারণে এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যতে নেমে এসেছে। এটা ভালো লক্ষণ হলেও যারা পরীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের মনের মধ্যে আতঙ্ক থেকেই যায়। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা কিংবা বাইরে থেকে প্রশ্নের উত্তর জেনে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে স্মাট মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করার পর প্রতিটি পরীক্ষার্থীর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের অযাচিত ডিভাইজ রয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য অন্তত আধা ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। সে কারণে পরীক্ষার প্রবেশপত্রে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া থাকে। তারপরও বিলম্ব হয়। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা হলের অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেয় না। যাত্রাপথে গুগলের সহায়তা নিয়ে পরীক্ষার হলো খুঁজতে থাকে। অনেক পরীক্ষার্থী ভুল বাসে উঠে বসে। আবার অনেকে চালককে বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও চালক বাস সামনের দিকে এগিয়ে নেন না। যাত্রাপথে বাসে বাসে ‘পাড়াপাড়ি’-এর কারণে অনেক সময় মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন বাস শ্রমিকরা। তখন তা মীমাংসা হতে সময় নেয়। এখনেও দেরি হয়। তবে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কেউ কেউ কোনো প্রকার নাস্তা খান না। পরীক্ষার হলের বাইরে কোনো দোকান থেকে চা নাস্তা খেয়ে নেয়ার চিন্তাভাবনা করেন। আবার অনেকে ধূমপায়ী হওয়ায় পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগে বন্ধুদের সঙ্গে সেই কাজটিও করে নেন। অনেকে পরীক্ষা শুরুর আগের কয়েকটা মিনিট রিভিশন দেয়ার নামে সময়ের অপচয় করেন। ফলে ঘণ্টা পড়ার আওয়াজ তাদের কানে যায় না। অথচ পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। সারা বছর পড়ালেখায় মনোযোগ না দিয়ে পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশোনা করার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে বিলম্ব হয়। যারা হল কিংবা মেসে থাকেন, তারা সকলে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজটি করতে গিয়ে সিরিয়ালে পড়ে যান। রাস্তায় বের হয়ে যানবাহনের অভাব না থাকলেও ভিড়ের মধ্যে পড়ে যান অনেকে। কখনো কখনো যানবাহনে উঠার আগেই যানবাহন চলা শুরু করে। তখন একজন পরীক্ষাথীর অসহায়ত্ব দেখে অনেকে হয়তো আফসোস করেন। আবার অনেকে ‘ধিক্কার’ দেন। চাকরির পরীক্ষা হোক কিংবা কোনো ভর্তি পরীক্ষাই হোক রাস্তার যানজট রাজধানী ঢাকা শহরের একটি অন্যতম মৌলিক সংকট। সেই বিষয়টি কেন আমাদের দেশের পরীক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারেন না, সেটাও বোধগম্য নয়। পরীক্ষার আগের দিন-রাতে বন্ধুদের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রশ্ন নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে গভীর রাত হয়ে যায়। অনেকের অভিভাবক বিষয়টি নিয়ে সন্তানদের ওপর কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করতে চান না। আবার অনেকে পরিণত বয়সে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কারণে তাদের পরামর্শ দেয়ার মতো মন-মানসিকতা অনেকেই হারিয়ে ফেলেন। সে কারণেও পরীক্ষার দিনে সময় নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার অভ্যাস আমাদের সন্তানদের মধ্যে নেই। বাসা থেকে পরীক্ষা হল পর্যন্ত হাজারো সংকট ও বিড়ম্বনা আসতে পারে, সেই বিষয়টি বার বার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ সতর্ক করলেও কে শুনে কার কথা। বাস্তবতার নিরীক্ষে পথ চলার রীতিনীতি যারা অনুস্মরণ করেন না তাদের, এমনি অনকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখো হতে হয়। পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময় শেষ হওয়ার পর পরীক্ষা না দিতে পেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ আমাদের সন্তানরা সতর্ক হচ্ছে না। সচেতন হচ্ছেন না আমাদের অভিভাবকরাও। কোনো কোনো অভিভাবকের অভিযোগ সন্তান কথা শুনে না। আমরা কি করব। আবার সন্তানরা পাল্টা প্রশ্ন করেন ‘আমরা বড় হয়েছি না’। বড় হওয়া কিংবা না হওয়া এখানে কোনো বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে বাস্তবতা। আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি। পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে যা হওয়ার তাই হয় এবং গতকাল গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী কয়েক মিনিট দেরি করে হলে যাওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এরআগে বিসিএস পরীক্ষায় রাজধানীর একটি কেন্দ্রে বেশ কিছু পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে না পেরে রাজপথে গড়াগড়ি করেছেন। সেই দৃশ্য গণমাধ্যমে এসেছে। সেই দৃশ্য যারা দেখেছেন তারা কোনো দিন পরীক্ষার সময়ের ব্যাপারে অবহেলা করবেন না এটা নিশ্চিত। গতকাল গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে দেরি করে আসা পরীক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বেলা ১১টা ৫ মিনিটের পর ক্যাম্পাসের সব গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ের পর আর কোনো পরীক্ষার্থীকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বেলা ১১টায় শুরু হওয়া এক ঘণ্টার এই পরীক্ষা দিতে দেরি করে আসা কোনো কোনো শিক্ষার্থী জানা, ‘গুলিস্তান পর্যন্ত এসেছি তেমন যানজট ছিল না। কিন্তু গুলিস্তান থেকে এই পর্যন্ত আসতে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় লেগেছে। মাত্র ৫ মিনিট দেরি হয়। সব গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি ফেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ‘সেন্ট্রাল কমিটি থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ১১টার পর কাউকে যেন প্রবেশ করতে দেওয়া না হয়। তাও আমরা ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত প্রবেশ করিয়েছি। এরপর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র পরিদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম বলেন, ‘এটা কোর কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল। এর আগের ইউনিটগুলোর পরীক্ষার দিনে যদি কেউ দেরি করে প্রবেশ করে থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের পাশে রিপোর্টেড লেখা ছিল। সর্বোপরি কথা হচ্ছে যারা গতকাল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই। তবে বিনীত অনুরোধ থাকবে আগামীতে পরীক্ষার দিনে যেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।