ডায়রিয়া, কলেরা, বমি, আমাশয়, পাতলা পায়খানা, অতিরিক্ত ঘাম বা অন্য যে কোনো কারণঘটিত পানিশূন্যতার ক্ষেত্রে খাবার স্যালাইন বা ওরাল স্যালাইন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। খাবার স্যালাইন হলো শরীরের পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি পূরণ করার জন্য পানির সাথে বিভিন্ন লবণ ও গ্লুকোজের মুখে গ্রহণযোগ্য দ্রবণ। বাজারে মুখে খাবার এই স্যালাইন ওরস্যালাইন-এন, ওআরএস, ওআরএস-এ, নিওস্যালাইন, স্যালাইন-আর, ওরালাইট ইত্যাদি বিভিন্ন নামে প্রচলিত। মুখে খাবার স্যালাইনের আবিষ্কারক ডা. রফিকুল ইসলাম। তিনি আইসিডিডিআর,বিতে চাকরিকালীন খাবার স্যালাইনের মতো বেশকিছু ওষুধ আবিষ্কার করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রচুর বাংলাদেশি শরণার্থী কলেরা ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হন। ওই সময়ে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে খাবার স্যালাইনের প্রয়োগ করেন ডা. রফিকুল ইসলাম। এতে যথেষ্ট ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার তাঁর খাবার স্যালাইনের এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খাবার স্যালাইনকে জীবনরক্ষাকারী হিসেবে অনুমোদন একে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি প্রদান করে।
খাবার স্যালাইনের আবিষ্কারকে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার’ বলে উল্লেখ করেছিল ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য ল্যান্সেট’। পরে ব্র্যাক এই মুখে খাবার স্যালাইনকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বাজারে প্রচলিত খাবার স্যালাইনের প্যাকেটে বা স্যাশেতে স্যালাইন বানানোর জন্য ১০.২৫ গ্রাম প্রয়োজনীয় পাউডার বা গুঁড়া থাকে। এর উপাদান হিসেবে থাকে ১.৩০ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণ, ০.৭৫ গ্রাম পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ১.৪৫ গ্রাম ট্রাই-সোডিয়াম সাইট্রেট ডাইহাইড্রেট এবং ৬.৭৫ গ্রাম এনহাইড্রাস গ্লুকোজ। খাবার স্যালাইনের এই স্যাশে আলো ও আর্দ্রতা থেকে দূরে ৩০ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করতে হয়। তবে জরুরি অবস্থায় বাজারে প্রচলিত প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন হাতের কাছে না পেলে সে ক্ষেত্রে বাসা-বাড়িতে ঘরোয়া পদ্ধতিতেও খাবার স্যালাইন তৈরি করা যায়। খাবার স্যালাইনের দ্রবণ বানানোর শুরুতে অবশ্যই দুই হাত, স্যালাইন বানানোর পাত্র এবং চামচ ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। প্রথমে স্যালাইন বানানোর পাত্রে ২ পোয়া বা আধা লিটার বিশুদ্ধ ফোটানো পানি নিতে হবে। এই পানিতে স্যালাইনের প্যাকেটের পুরো পাউডারটিই ঢেলে দিতে হবে। পরিষ্কার চামচের সাহায্যে পাউডার ও পানি ভালোভাবে মিশিয়ে নিলে তৈরি হয়ে যাবে ব্যবহার উপযোগী খাবার স্যালাইন। প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইনের পাউডার দিয়ে তৈরি এই ওরাল স্যালাইন একবার পানিতে মেশানোর পর ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। যদি ১২ ঘণ্টা পর স্যালাইন পানি অবশিষ্ট থাকে তবে তা ফেলে দিয়ে পুনরায় নতুন করে তৈরি করতে হবে। কারণ ১২ ঘণ্টা পর সেখানে জীবাণুর সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। এই স্যালাইন পান করলে শরীরে জীবাণুর আক্রমণ হতে পারে। তৈরির পর কোনো অবস্থাতেই স্যালাইন পানি গরমও করা যাবে না। কারণ, এতে স্যালাইনের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন হাতের কাছে না পেলে নিজেই স্যালাইন তৈরি করে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আধা লিটার পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। পরে এই পানিতে তিন আঙুলের এক চিমটি লবণ ও এক মুঠো গুড় মিশিয়ে চামচ দিয়ে ভালো করে নেড়ে পরিষ্কার ছাঁকনির সাহায্যে ছেঁকে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে বাসায় বানানো খাবার স্যালাইন। অথবা ১ লিটার ফুটানো বিশুদ্ধ পানির সাথে আধা চা চামচ লবণ এবং ৬ চা চামচ চিনি মিশিয়ে ভালো করে নাড়িয়ে নিলেও একইরকম খাবার স্যালাইন তৈরি হয়ে যাবে। এভাবে বাসায় তৈরি খাবার স্যালাইন ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। ৬ ঘণ্টা পর স্যালাইন পানি অবশিষ্ট থাকলে তা ফেলে দিয়ে পুনরায় নতুন করে তৈরি করতে হবে। একইরকমভাবে একবার তৈরির পর এই স্যালাইন পানিও আর গরম করে ব্যবহার করা যাবে না। বেশিরভাগ মানুষই খাবার স্যালাইন তৈরির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে ভুল করেন। তাদের ধারণা, যখন বেশি পাতলা পায়খানা হচ্ছে বা পানিশূন্যতা তীব্র, তখন একটু ঘন করে গোলানো স্যালাইন পানি বারবার শিশুকে খাওয়ালে মনে হয় তার সন্তান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আবার অনেকেরই বিশ্বাস, শিশু ছোট বলে অল্প অল্প করে স্যালাইন বানাতে হবে অর্থাৎ স্যালাইনের প্যাকেট পুরোটা না মিশিয়ে সামান্য গুঁড়া নিয়ে অল্প পানি দিয়ে বানানো যাবে- এগুলো কিন্তু একদমই ভুল ধারণা। খাবার স্যালাইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। খাবার স্যালাইন বানানোর সময় কোনোভাবেই পানি বা স্যালাইন পাউডারের পরিমাণ কম-বেশি করা যাবে না (যেমন- ২৫০ মিলিলিটার পানিতে দুই প্যাকেট স্যালাইন মেশানো, আধা লিটার পানিতে আধা প্যাকেট স্যালাইন মেশানো ইত্যাদি); এরকম হলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তো পাওয়া যাবেই না বরং তা বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। কেউ যদি নির্দেশনার চেয়ে অল্প পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়ান, তাহলে স্বাভাবিকভাবে শরীরে লবণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। এর প্রভাবে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের। এছাড়া কিডনি বিকল হয়েও পড়তে পারে। একসময় কোষগুলো নষ্ট হবে এবং তা থেকে মৃত্যু হওয়াও বিচিত্র নয়। এছাড়া কোনোভাবেই স্যালাইনে পানি ছাড়া অন্য কিছু যেমন দুধ, স্যুপ, চিনি, বা ফলের জ্যুস বা সফট ড্রিংকস ইত্যাদি মেশানো যাবে না। শিশুদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে খাবার স্যালাইন কাপে করে খাওয়ানোই ভালো, কারণ প্রায়শই শিশুদের ফিডিং বোতল পুরোপুরি পরিষ্কার করা ঝামেলা হয়ে যায়। অনেকে ভেবে থাকেন যে, ডায়রিয়া থেকে সৃষ্ট পানিশূন্যতার ক্ষেত্রেই কেবল খাবার স্যালাইন ব্যবহার করা যায়। তবে বিষয়টি ভুল। ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতার ক্ষেত্রে মুখে খাবার স্যালাইন বহুল প্রচলিত হলেও আরো বিভিন্ন কারণে শরীরে তৈরি হওয়া লবণ ও পানির ঘাটতি পূরণে এই ওরাল স্যালাইন ব্যবহার করা যায়। ডায়রিয়ার পাশাপাশি কলেরা বা আমাশয় হলে, বমি হলে, সূর্যের তাপে অনেকক্ষণ সময় কাটালে, ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের পর অতিরিক্ত ঘাম হলে, শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ সেলসিয়াস বা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বৃদ্ধি পেলে ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মুখে খাবার স্যালাইন ব্যবহার করে শরীরে সৃষ্ট লবণ-পানির ঘাটতি পূরণ করা যায়। পানিশূন্যতা তৈরি হলে শরীরে লবণ-পানি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে তাড়াহুড়া করা যাবে না; ধীরে ধীরে করতে হবে। তাই খাবার স্যালাইন একবারে অনেকটুকু না খেয়ে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খেতে হবে। শিশুর যদি ডায়রিয়া হয় এবং পানিশূন্যতার তেমন কোনো লক্ষণ না থাকে, সে ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ২ বছরের কম হলে শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে ৫০ মিলিটার থেকে ১০০ মিলিটিনার পরিমাণে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
চামচে হিসাব করলে যা ১০ থেকে ২০ চা চামচের মতো দাঁড়ায়। আর শিশুর বয়স ২ বছরের বেশি হলে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে ১০০ মি.লি. থেকে ২০০ মি.লি. পরিমাণে খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। চামচে হিসাব করলে যা ২০ থেকে ৪০ চা চামচের মতো দাঁড়ায়। স্যালাইন খাওয়ানোর পরে শিশু বমি করলে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে আবার স্যালাইন খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আর শিশুর যদি ডায়রিয়া হয় এবং পানিশূন্যতার মৃদু লক্ষণ থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রথম ৪ ঘণ্টার ভেতরে শিশুর বয়স ও ওজন অনুসারে খাবার স্যালাইন দিতে হবে, যেমন- > বয়স ৪ মাস পর্যন্ত ওজন ৪ কেজির কম হলে ২০০-৪৫০ মি.লি. > বয়স ৪ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ওজন ৪ কেজি থেকে ১০ কেজি হলে ৪৫০-৮০০ মি.লি. > বয়স ১২ মাস থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ওজন ১০ কেজি থেকে ১২ কেজি হলে ৮০০-৯৬০ মি.লি. > বয়স ২৪ মাস থেকে ৬০ মাস পর্যন্ত ওজন ১২ কেজি থেকে ২০ কেজি হলে ৯৬০-১৬০০ মি.লি। পানিশূন্যতার লক্ষণ তীব্র হলে শিশু কিংবা বয়স্ক যে-ই হোক না কেন, দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। ডায়রিয়া হলে শুধু খাবার স্যালাইন নয়, সাথে তরল জাতীয় অন্যান্য খাবারও খাওয়াতে হবে, যেমন স্যুপ বা জুস, ডাবের পানি, ভাতের মাড় ইত্যাদি। স্যালাইন খাওয়ানোর সময় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ রাখা যাবে না। শিশু যদি ৬ মাসের বেশি বয়সি হয়, তাহলে অর্ধ-তরল বা শক্ত খাবারও দেওয়া উচিত। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে কমপক্ষে বড় কাপের (২৫০ মি.লি.) পুরোটা থেকে ২ কাপ অর্থাৎ স্যালাইনের প্যাকেটের পুরোটা খেতে হবে। খাবার স্যালাইন প্রাণরক্ষাকারী একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। কিন্তু এজন্য অবশ্যই শরীরে এর সঠিক অনুপাতে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল প্রয়োগ যেমন ভয়ংকর, তেমনই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘনমাত্রায় খাবার স্যালাইনের ব্যবহার ব্যক্তিকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তেও নিয়ে যেতে পারে। বছরের উষ্ণতম এই দিনগুলোতে তাই খাবার স্যালাইনের হোক সঠিক মাত্রায় যথাযথ ব্যবহার।