রংপুর পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল লোকবলের অভাবে পড়ে আছে ৩১ কোটি টাকার অবকাঠামো। উদ্বোধনের ১৪ মাস পেরিয়ে গেলেও চালু হয়নি রংপুর ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল। এটির কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় রয়েছেন স্থানীয়রা। অত্যাধুনিক অবকাঠামোসহ চিকিৎসার নানা সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালক্ষেপণে ক্ষোভ বাড়ছে তাদের। তবে এটি কবে নাগাদ চালু হবে, তা জানেন না স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অত্যাধুনিক হাসপাতাল ভবনে যেন সুনসান ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আবাসিক চিকিৎসক, চার নার্স ও নিরাপত্তাপ্রহরীরা কর্মহীন অলস সময় কাটাচ্ছেন। চত্বরে শিশুদের জন্য নির্মিতি বিভিন্ন খেলার রাইডগুলো ধুলায় মলিন হয়ে পড়ে আছে। এদিকে, জেলার শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা সংকটে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছে। রোগী ও স্বজন, চিকিৎসক-নার্সদের অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অবিলম্বে বিশেষায়িত হাসপাতালটি চালুর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নগরীর সাবেক সদর হাসপাতাল চত্বরে ১ দশমিক ৭৮ একর জমির ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেলা সিভিল সার্জনকে ভবনটি হস্তÍান্তর করেছিল। তিনতলার হাসপাতালে রয়েছে ইমার্জেন্সি, আউটডোর, চিকিৎসকদের চেম্বার, ল্যাব, অপারেশন থিয়েটার, ব্রোন ইউনিট, ওয়ার্ড ও কেবিন। হাসপাতাল চত্বরে আছে সুপারিনটেনডেন্ট কোয়ার্টার, ডক্টরস কোয়ার্টারস, স্টাফ অ্যান্ড নার্স কোয়ার্টারস, ড্রাইভার কোয়ার্টারস। বিদ্যুতের সাবস্টেশন স্থাপনের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ায় ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল এটিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সম্প্রসারিত ভবন ‘করোনা ডেডিকেটেড আইসোলেশন হাসপাতাল’ হিসেবে চালু করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে করোনা কেটে গেলেও হাসপাতালের কার্যক্রম আজও শুরু হয়নি। এ অবস্থায় দ্রুত হাসপাতাল চালুর দাবি তোলেন স্থানীয়রা।
তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির উদ্বোধন করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতাল মিলনায়তনে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানান, হাসপাতালে ১৫ শয্যার আইসিইউ, সিসিইউ, ৭০ থেকে ৮০টি শয্যায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে। রংপুর বিভাগ ও পাশের জেলার শিশুদের চিকিৎসায় হাসপাতালে দ্রুত জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে। তবে এখনো উদ্বোধনেই আটকে আছে। জনবল নিয়োগ হয়নি, দেওয়া হয়নি যন্ত্রপাতি।
রংপুর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাবুল আলম জানান, সাড়ে ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২ বছর সময় বেধে দেওয়া হলেও এর আগেই কাজ শেষ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের প্রথমতলায় জরুরি ও বহির্বিভাগ, চিকিৎসকদের চেম্বার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাব রয়েছে। দোতলায় অপারেশন থিয়েটার ও বার্ন ইউনিট এবং তিনতলায় শিশু ওয়ার্ড ও কেবিনের ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা আলাদা ভবন রয়েছে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ হাসপাতাল ভবন জেলা সিভিল সার্জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে এখনো শিশু হাসপাতালের প্রয়োজনীয় জনবল এবং শিশু স্বাস্থ্যসেবার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়নি।
জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির জানান, এটি চালু করতে প্রশাসনিক অনুমোদন প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল পাওয়া গেলে চালু করা হবে।
কবে হাসপাতালটি চালু হবে, জানতে চাইলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস আলী বলেন, ‘গত ১৫ জানুয়ারি বহির্বিভাগ চালুর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিঠি পেয়েছি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করছি, দ্রুতই বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালু করতে পারবো। তবে পূর্ণাঙ্গরূপে সেবা দিতে অনেক জনবলের প্রয়োজন। জনবল ও সরঞ্জাম চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য একজন সুপার নিয়োগ দিতে হবে। আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে। এসবের কিছুই এখনও হয়নি। সবকিছু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুমোদন দেওয়ার পর জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম স্থাপনের পর চালু করা যাবে। আপাতত এক চিকিৎসক দিয়ে আউটডোর চালু করা হলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ, হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা দুই কিলোমিটার দূরে যেতে চান না।’
এ ব্যাপারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. এ বি এম আবু হানিফ বলেন, ‘হাসপাতালটির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এবং জনবলের চাহিদা নির্ধারণ করে বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। দাপ্তরিক কাজ চলছে। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’
উদ্বোধনের এতদিন পরও হাসপাতাল চালু না হওয়ায় মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে- জানিয়ে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘বিষয়টি স্থানীয় এমপি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেখা উচিত। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করার পরও এটি চালু না হওয়া দুঃখজনক। দ্রুত হাসপাতালটি চালুর দাবি জানাই।’