কুষ্টিয়ার ছয়জনের কারসাজিতে গায়েব হয়ে গেছে সরকারের ১১শ’ কোটি টাকার সার। বন্দর থেকে খালাসের পর উধাও হয়ে গেছে সরকারের আমদানি করা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার। বিদেশ থেকে আমদানি করা এই সার পরিবহণের দায়িত্ব পেয়েছিল মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সি। তবে চুক্তির পর দুই বছর পার হলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএডিসি) সার বুঝিয়ে দেয়নি এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) আওতাধীন কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায়ও এর প্রমাণ মিলেছে। তা সত্ত্বেও খোয়া যাওয়া সার উদ্ধারে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএডিসি। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো সার বুঝিয়ে না দিলে জরিমানার বিধান থাকলেও নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। এমনকি এ নিয়ে কথা বলতেও অনীহা সংস্থাটির কর্মকর্তাদের। এদিকে সরকারি ১১শ’ কোটি টাকার সার জালিয়াতির মূলহোতাদের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া ট্রেডিং নামে ওই ঠিকাদারি এজেন্সি ছয়জন পার্টনার রয়েছে। এদের কারসাজিতেই গায়েব হয়েছে সরকারের এই বিপুল পরিমাণ সার। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, এদের সবার বাড়ি কুষ্টিয়া শহরে। এরা (ভাই-দাদা সিন্ডিকেট নামে শহরে পরিচিত) এদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোখলেসুর রহমান নান্নুর বাড়ি শহরের ছয় রাস্তার মোড়ে। অপর দুই পার্টনার সনজ কুমার সাহা ও নরেন্দ্রনাথ সাহার বাড়ি শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকায়। আরেক পার্টনার সাব্বিরের বাড়ি জিকে স্কুলের পেছনে। এছাড়া খোকনের বাড়ি হাসপাতাল মোড়ে এবং মিন্টুর বাড়ি বড় বাজার এলাকায়। তবে মিন্টু মারা যাওয়ার পর ওই শেয়ারের দায়িত্ব নিয়েছেন তার শরিকরা।
ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক কর্মকর্তা সার কেলেংকারির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রতিষ্ঠানের এমডি মোখলেসুর রহমান এই কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না। ওই কর্মকর্তা এ ঘটনার সাথে সনজ কুমার সাহা ও তার ভাই স্বপন কুমার জড়িত বলে জানান। এ নিয়ে পার্টনারদের মধ্যে ঝামেলা চলেছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। এ ঘটনার পর ঢাকার অফিস বন্ধ করে হাওয়া হয়ে গেছেন এরা। তবে কুষ্টিয়া শহরের বড় বাজার এলাকায় এসি ব্যানার্জি রোডে কুষ্টিয়া টেডিং এজেন্সি লিমিটেড নামে তাদের প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত খোলা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিএপি ও টিএসপি সার পরিবহনের ক্ষেত্রে চুক্তি অনুসারে পরিবহন ঠিকাদারকে নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার যথাসময়ে বিএডিসিকে চূড়ান্তভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এমওপি সার পরিবহণের ক্ষেত্রে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজ আসার পর দ্রুত ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মধ্যে বিএডিসির বিভিন্ন গুদামে সার সরবরাহ করার কথা। যথাসময়ে সার পরিবহণে ব্যর্থ হলে প্রতিদিনের জন্য প্রতি মেট্রিক টনে ৫ টাকা হারে জরিমানা ধার্য করা আছে।
সংশ্লিষ্ট নথি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দরে মাদার ভ্যাসেলে সার আসার পর লাইটারিং, বস্তা সরবরাহ, ওজন, ব্যাগিং, সার্ভে এবং আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করে বিএডিসির বিভিন্ন গুদামে পরিবহনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিংকে সময়সূচি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই শর্ত যথাযথভাবে মানেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের আমদানি করা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন সার চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর থেকে খালাস করে বিএডিসিকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেই সার আদৌ দিয়েছে কি না বিএডিসি কর্মকর্তাদের কাছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। এ নিয়ে সংস্থাটির অন্তত ১০ জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকেই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে বিএডিসির উদাসীনতার সুযোগে মতিঝিলে নিজেদের অফিস একরকম বন্ধ করে দিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সি। অভিযোগ আছে, বিএডিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সখ্য থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছয়টি জাহাজে ২ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি ও এমওপি সার আমদানির জন্য এলসির মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিল অব লেডিং অনুযায়ী ৯০ হাজার মেট্রিক টন সার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে খালাস করা হয়েছে। এই সার গুদামে পৌঁছানোর জন্য কুষ্টিয়া ট্রেডিংয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিএডিসি। কিন্তু জাহাজ বহির্নোঙরে আসার পর এক বছর পার হলেও ৬৯৬ কোটি ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৪ টাকা মূল্যের ৯০ হাজার মেট্রিক টন সার সরবরাহ করেনি ওই ঠিকাদার। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে জরিমানা আদায় করা হলে নিরীক্ষাকাল পর্যন্ত তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৬৯৭ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৪ টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা সারের চালান সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক (চট্টগ্রাম) কামরুজ্জামান সরকার বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সির ৯০ হাজার মেট্রিক টন সার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে খালাস করে বিএডিসিকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। আমার জানামতে, এখন পর্যন্ত ২ হাজার মেট্রিক টন সার বাদে বাকি সব সার বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে দেরি করে সার বুঝিয়ে দেওয়ার কারণে যে জরিমানা হওয়ার কথা, তা আদায় করা হয়েছে কি না তা জানা নেই।
অন্যদিকে খুলনা বন্দর দিয়ে তিনটি জাহাজে ১ লাখ ৮ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন ডিএপি, এমওপি এবং টিএসপি সার আমদানির জন্য এলসির মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করে সরকার। এই আমদানির বিল অব লেডিং অনুযায়ী ৬৮ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন সার খুলনা বন্দরে খালাস করা হয়। এর মধ্যে ১৮ হাজার ২৪১ মেট্রিক টন বিএডিসির বিভিন্ন গুদামে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৪৯ হাজার ৮৪৪ মেট্রিক টনের কোনো হদিস নেই; যার মূল্য ৪১৮ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ টাকা। এ ক্ষেত্রে নিরীক্ষাকালীন পর্যন্ত জরিমানার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৬৩২ টাকা। এ ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ ৪১৮ কোটি ১৮ লাখ ৭৮ হাজার ২৭ টাকা।
এই সার সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক (খুলনা) লিয়াকত আলী বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সি বিএডিসিকে সার বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু কত মেট্রিক টন সার বুঝিয়ে দিয়েছে, তা সঠিকভাবে এখন বলা যাবে না। প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সার সরবরাহের বাস্তব অবস্থা জানতে বিএডিসির বিভিন্ন স্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগই মুখ খোলেননি। তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সির সার সরবরাহের বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছে। তবে অনেকেই বলেছেন, নিরীক্ষায় ধরা পড়ার পর কিছু পরিমাণ সার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বকেয়া রয়েছে বেশিরভাগ। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকায় বিষয়টি ধামাচাপার দিকে যাচ্ছে। একাধিক সূত্রের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিবহন ব্যবস্থাপক খসরু নোমানের বিশেষ সখ্য রয়েছে। এ কারণে এতদিন ধরে অপরাধ করার পরও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এমনকি জরিমানার টাকা আদায়েও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না বিএডিসি। যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত খসরু নোমান বলেন, ‘সার পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সির বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারব না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিষেধ আছে। পুরো বিষয়টি জানতে বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. আজিমউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এক সপ্তাহ ধরে কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত তার অফিসে গেলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন লিখে পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি। যদিও তিনি হোয়াটসঅ্যাপে সক্রিয় রয়েছেন। তবে কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সি মতিঝিল অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোখলেসুর রহমান অফিসে আসেন না। প্রায় দুই বছর ধরে কোনো কাজও নেই। এজন্য অনেক কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। অফিস এক ধরনের বন্ধ বললেই চলে।