প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপ রিমাল। রিমালের প্রভাবে দেশের ১৬ জেলায় ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড় রিমাল নিয়ে ১১ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগে বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে গতকাল সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে রিমাল বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে জানায়। আবহাওয়া অফিস। ইতিমধ্যে পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, রিমালের প্রভাবে ইতোমধ্যে কক্সবাজার সৈকত ও উপকূলে পানির উচ্চতা বেড়েছে। ঢেউ উপচে পড়ছে তীরে। রিমালের এ তীব্রতা দেখতে সৈকতের তীরে ভীড় জমিয়েছেন কক্সবাজারে অবস্থান করা পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। বেলাভূমির লাবণী, সী-গাল, সুগন্ধা, ওশান বিচ ও কলাতলী পয়েন্টে শত শত পর্যটক আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে উপচে পড়া ঢেউয়ের সাথে মিতালি গড়ে গোসলে নামছে। সমানে তাদের উপরে নিরাপদ স্থানে উঠে আসতে তাগাদা দিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের বিচকর্মী ও সৈকতে কাজ করা লাইফগার্ড কর্মীরা।
গত শনিবার বিকালেই আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্কতা জারি করে বলেছিল- রোববার রিমাল ঘূর্ণিঝড় হতে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। দুপুর ১২টা হতে সেভাবেই আচরণ করছে প্রকৃতি। বেড়েছে কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে ঢেউ এবং বাতাসের তীব্রতা। বিপদ বোঝাতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে লাল পতাকা টাঙানো হয়েছে। এরপরও নির্দেশনা না মেনে সৈকতে গোসলে নেমেছেন অনেক পর্যটক ও দর্শনার্থী।
সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা এবং লাবণী পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, টানা কয়েক মাস তীব্র তাপদাহে ভোগা স্থানীয়রা একটু শীতলতার আশায় এবং ঘূর্ণিঝড় রিমালের তীব্রতা দেখতে সৈকতের তীরে এসেছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি অনেক পর্যটকও এসে তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। মাঝারি বৃষ্টিপাতে দাঁড়িয়ে শীতলতা অনুভবের পাশাপাশি সমুদ্র পরিস্থিতিও দেখছেন তারা।
মানিকগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক দম্পতি ইব্রাহিম সায়মন বলেন, গত শনিবার কক্সবাজার এসে বিকালে জানতে পারি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। তিন দিনের ছুটি পেয়ে পরিবার নিয়ে এসেছি, এখন চলেও যেতে পারছি না। আবার কবে আসব নিশ্চয়তা নেই। তাই বৃষ্টি পেয়েই গোসলে নামতে এসেছি। তবে, অন্য দিনের চেয়ে ঢেউ অনেক বড় বলে মনে হচ্ছে। বিচকর্মী ও লাইফগার্ডরা পানিতে নামতে দিচ্ছেন না। গোসল করতে ব্যর্থ হলে খরচটা জলে যাবে!
স্থানীয় ওয়াহিদ রুবেল বলেন, বিগত কয়েক মাস চরম তাপদাহে জীবন ওষ্ঠাগত ছিল। গতকাল রোববার দুপুর হতে একটু বৃষ্টির দেখা পেয়েছি। সাথে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কী হচ্ছে, তা দেখতে এসেছি। তবে, সমুদ্রে নামছি না- পাশাপাশি সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে উৎসাহ দিচ্ছি। কারণ, নির্দেশনা না মানলে বিপদ হতে হবে। সমুদ্রের বড় ঢেউ সত্যি উপভোগ্য।
লাইফগার্ড রিফাত ইসলাম বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে এক স্থানে বাধা দিলে অন্য স্থান দিয়ে নামছেন। রূঢ় আচরণও করা যাচ্ছে না। বিপদসংকেত বুঝাতে লাল পতাকা টানানো হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, দুর্যোগের আভাস পেয়েই জেলায় ৬৩৮টি সাইক্লোন সেন্টার খুলে দেয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী জরুরি মোকাবিলায় জিআর নগদ ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যবস্থাপনা তহবিলের ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৮ টাকা, ৪৮৬ মেট্রিক টন চাল মজুত রাখা হয়। খোলা হয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। দুর্যোগকালীন এ সময়ে মাঠে কাজ করছে ৮ হাজার ৬০০ জন সিপিপি এবং ২ হাজার ২০০ জন রেড ক্রিসেন্ট সদস্য। উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার পূর্ব-প্রস্তুতি মতে ইউএনওরা কাজ করছেন। গত শনিবার সন্ধ্যায় জরুরি মিটিং শেষ করেই সিপিপি ও অন্য স্বেচ্ছাসেবক টিমগুলো সচেতনতা বাড়াতে উপকূলে মাইকিং নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাঠে রয়েছে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক টিম, রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সেন্টমার্টিনে বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যে দ্বীপের চারপাশে আগের তুলনায় সাগরের পানির উচ্চতা ৩ থেকে ৪ ফুট বেড়ে গেছে। এ কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে টেকনাফসহ সেন্টমার্টিনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। বিষয়টি জানিয়ে টেকনাফ থানার ওসি ওসমান গনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় রেমালে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
এ সংকেত জানার পরপরই টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনির পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিসহ টেকনাফ, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও হ্নীলায় মাইকিং করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয় যেতে বলা হচ্ছে। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় পুলিশের টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
টেকনাফ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফকাত আলী বলেন, বিপদ সংকেত বৃদ্ধি হলে সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের উপকূলে বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। দ্বীপসহ উপকূল ইউনিয়নে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার-পানি মজুত রাখার পাশাপাশি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।