নেত্রকোনায় পতিত জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষে লাভবান হয়েছেন কৃষক। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এসব জমিতে এ বছর ৪৭ কোটি টাকার মিষ্টিকুমড়া উৎপাদিত হতে পারে। যুগের পর যুগ পতিত থাকা এসব জমিতে ফসল ফলানোর এই অভাবনীয় সাফল্যে কৃষকের মুখেও হাসি ফুটেছে। জেলার হাওর ও চরাঞ্চলে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকা জমিতে চার বছর আগে মিষ্টিকুমড়া চাষে হাত দেন কৃষকরা। লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়তে থাকে আবাদি জমির পরিমাণও। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫২৮ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। এ বছর ১৩২ হেক্টর বাড়িয়ে মোট ৭২০ হেক্টর জমিতে চাষ করেছেন কৃষকরা। উৎপাদিত ২০ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন কুমড়ার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হাওরের অনাবাদি ৩৫০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হাইব্রিড জাতের মিষ্টিকুমড়া। সেখানে উৎপাদিত ১১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন কুমড়ার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। এরই মাঝে কৃষকরা উৎপাদিত কুমড়া বিক্রি শুরু করেছেন। ভালো ফলন পেয়ে খুশির কথা জানিয়েছেন কৃষকরা। পাশাপাশি বাজারে দাম নিয়ে সন্তুষ্ট তারা। তারা বলছেন, ক্রেতারা এই মিষ্টিকুমড়া ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে কিনছেন। হাওরের বুক চিরে বয়ে গেছে ধনু নদী। তার পাশেই মনোহরপুর কান্দার হাওরে দুপুরের প্রখর রোদ উপেক্ষা করে কুমড়া তুলতে ব্যস্ত হাফিজুর রহমান। বাড়ি খালিয়াজুড়ি উপজেলার নুরপুর বোয়ালী গ্রামে। কাজের ফাঁকেই কথা বলছিলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি জানান, এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এগুলো এক সময় পতিত জমি ছিল। গত কয়েক বছর ধরে আমরা নিজ উদ্যোগে এখানে মিষ্টিকুমড়া আবাদ করে আসছি। এ বছর ৪ একর জমি চাষ করেছি। আমরা ৮ জন এক সঙ্গে হয়ে এই আবাদ করছি। আশা করছি ভালো ফসল তুলতে পারব। তবে এ বছর বৃষ্টি আমাদের কিছুটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও আশা করছি ভালো ফলন পাব। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতা পেলে আরও ভালো আবাদ ও ফসল উৎপাদন করতে পারতাম। আরেক উদ্যমী তরুণ ইমরান খান। তার বাড়ি তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে। তিনি এখানে এসে যুক্ত হয়েছেন হাফিজুরের সঙ্গে। দিন-রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন নিজের হাতে গড়ে তোলা এই বিশাল কুমড়া খেতে। ফলন কেমন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই কথা কওনের সময় নাই। এহনো মেলা লাউ তুলন লাগব। একটু পরেই পাইকার আইবো, হেরারে মাল বুঝায়া দেওন লাগব। দাম কেমন পাচ্ছেন প্রশ্ন করলে সোজা উত্তরে বলেন, লাউয়ের দাম কম। বাজার একদম খারাপ। ১৬ লাখ টেহা খরচ কইরা এহন বেচন লাগব ২০-২২ লাখ। এতো টেহা খাটায়া আটজন মানুষে কয় টেহা পামু? আমরা নিজেরা তো কামলা দিতাছি। লগে আরও কাম করণের মানুষ নিছি, তারার রোজের টেহা দেওনের পরে আমরার কয় টেহা থাকব আপনেই কন? বাজারটা একটু ভালো থাকলে লাভ হইত। পতিত জমিতে আবাদ বাড়ায় এসব জমিতে কাজ করছেন অনেক বেকার যুবক। তাদেরই একজন নাছির আহমেদ নাঈম। তার বাড়িও নুরপুর বোয়ালী গ্রামে। সংসারে অভাব থাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছেন এই মিষ্টিকুমড়ার খেতে। তার দাবি এই চাষের কারণে তিনি প্রতক্ষ্যভাবে উপকৃত হচ্ছেন। নাঈম বলেন, আগে আমরা বেকার ছিলাম। সংসারে অভাব লেগেই থাকত কিন্তু এখানে কাজের সুযোগ পাওয়ার পর কিছু টাকা ইনকাম করতে পারছি। যেটা দিয়ে সংসারে কিছুটা সাপোর্ট দিতে পারি। এখন সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা এসেছে। জগন্নাথপুর ময়েজ উদ্দিন সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, করোনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী কৃষি বিভাগ ও সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল দপ্তরের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে হাওরে ধীরে ধীরে মিষ্টিকুমড়া চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার মাটি খুব উর্বর হওয়ায় ফসল ভালো হয়। পতিত পড়ে থাকা ৯০ শতাংশ জমি এখন চাষের আওতায় এসেছে। এতে করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। জমির মালিকরা আলাদাভাবে ভালো পরিমাণ টাকা ভাড়া হিসেবে পাচ্ছেন।
আগে এসব জমিতে কেউ চাষ করতো না। খেলার মাঠ ও গরুর চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার হতো। একদিকে থেকে চিন্তা করলে কৃষি বিভাগ সফল হয়েছে। আসলেই এখন আপনি হাওরে পতিত জমি খুঁজে পাবেন না। ১নং মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের পর পর দুইবার নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যন মো. লোকমান হেকিম বলেন, আমি যখন (২০২০-২০২১ সালে) চেয়ারম্যান ছিলাম তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম ও কৃষি অফিসের সহযোগিতায় কৃষকদের হাতে কিছু বীজ দিয়ে তাদের পতিত জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি চাষে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা শুরু হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একান্ত চেষ্টায় ও কৃষকরা লাভবান হওয়ায় এখন সামান্য জমিও খালি থাকে না। এখন জগন্নাথপুরের চারিদিকের হাওর যেমন, মনোহরপুর কান্দা হাওর, ঝাউরার দুয়ারকান্দা হাওর, চর হাওর, রসুলপুর হাওর, কুড়ের কান্দা হাওরসহ বিভিন্ন হাওরে বাণিজ্যিকভাবে কুমড়ার চাষ হচ্ছে। কৃষকরা ভালো দামে হাওরেই পাইকারের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন তাদের উৎপাদিত ফসল। কৃষক উৎপাদিত এই মিষ্টিকুমড়া ঘিরে হাওরেই গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ মোকাম। সেখানের কুমড়া পাইকারের ট্রাকে করে চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আড়ত ও বাজারে। ট্রাকে কুমড়া লোড করতে ব্যস্ত ছিলেন আব্দুর রউফ। তিনি মূলত পাইকার। হাওর থেকে মিষ্টি কুমড়া কিনে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেন ঢাকার কাওরান বাজারে। তিনি বলেন, এই এলাকা মূলত এক ফসলি এলাকা। আগে শুধু একবার ধান চাষ করা হতো। পানি আসলে ধান সব নষ্ট হয়ে যেত। এখন পতিত জমিগুলোতে মিষ্টিকুমড়া আবাদ হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। হাওরের মোকামে এসেছেন আরেক পাইকার আব্দুল লতিফ। কেমন দামে কিনছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আজকে ১৪ টাকা দরে কিনছি। একটু পরে ট্রাকে লোড করে ঢাকা পাঠিয়ে দেব। পাশাপাশি চট্টগ্রাম, পাবনা ও খুলনায় যায়। ৩-৪ বছর ধরে এ মোকাম থেকে মিষ্টিকুমড়া কিনি। কখনো লাভ হয়, কখনো লস হয়। তবে বছর শেষে ভালো লাভ হয়। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পতিত জমি চাষের আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। তারই একটি হচ্ছে হাওরের পতিত জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ। জেলায় সাড়ে পাঁচ হাজার কৃষক মিষ্টিকুমড়া চাষে যুক্ত হয়েছেন। কৃষকদের, প্রশিক্ষণ, সার, বীজ ও বালাইনাশক দেওয়ার পাশাপাশি ৬০টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষকদের আবাদে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। জেলায় এ বছর ৭২০ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়েছে। তার মধ্যে হাওরেই সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে খালীয়াজুরি ও মদন উপজেলায়। এ ফসলে রোগ ও পোকাড় আক্রমণ কম হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন। ফসল বিক্রি করে তারা দামও ভালো পাচ্ছেন। এবং বাইরের পাইকাররা হাওর থেকেই কুমড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মার্কেটের সঙ্গে কৃষকদের যোগাযোগও ভালো। তাই তারা ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন।