দীর্ঘদিন বন্ধ কুষ্টিয়া সুগার মিল

ধ্বংসের মুখে তবুও নজর নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের

শ্রমিক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবনযাপন

প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এ.এইচ.এম. আরিফ, কুষ্টিয়া

১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়া সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। এরপর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি এখন ধ্বংস্তূপে পরিণত হতে চলছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কুষ্টিয়া চিনি কলের কর্মহারা শ্রমিক-কর্মচারীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেই কারখানার ইনচার্জ জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারখানার যে ভবনগুলো বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। তারা পরিদর্শনও করেছেন কয়েকবার। রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পেলেই মেরামত করা হবে। কুষ্টিয়া চিনিকলের সূত্রে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশপত্রে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে জানানো হয়- চিনি উৎপাদন, আখের জমি হ্রাসকরণ, মিলের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা, লোকসান ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকলসহ দেশের ছয়টি চিনিকল ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে আখ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদন স্থগিত করে সরকার। সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে আখ মাড়াই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য অর্থ ব্যয় করা লাগবে ৫৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে চিনি মোলাসেস-সহ বায়োপ্রডাক্ট খাত থেকে ২৫০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আয় হলেও অবশিষ্ট ২৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেয়া লাগবে।

উল্লেখ্য, এমনিতেই পূর্ববর্তী অর্থ বছরে চাষিদের আখ ক্রয়ে ভর্তুকি বাবদ ১২৩ কোটি টাকা অনুমোদন হলেও তা ছাড় না করায় আখ চাষিদের পাওনাদি, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা বকেয়ার বোঝা চেপেই থাকে চিনিকলের ঘাড়ে। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে অলাভজনক বা লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত কুষ্টিয়া চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রাখা অনিবার্য হয়ে পড়ে। চাষাবাদে অতি উর্বর কুষ্টিয়ার মাটিতে আখ চাষের সেরা মানের পরিবেশ থাকায় ১৯৬১ সালে ২২১ দশমিক ৪৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া চিনিকল। ১৯৬৫-৬৬ অর্থবছর থেকে শুরু হয় আখ মাড়াই কার্যক্রম। পরে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রয়াত্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার।

কুষ্টিয়া চিনিকলের শ্রমিক মিনাপড়ার রেজাউল করীম (৭৫) বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরির শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী মিলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের আয়-রোজগারের কেন্দ্র ছিল। চলছিলও ভালোই, লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্নে আর অবহেলায়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার ফলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কর্তৃপক্ষ দোষ দেয় শ্রমিক সংগঠনকে। আর শ্রমিকরা দোষারোপ করে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে। বন্ধ হওয়া কারখানাটি এখন আস্তে আস্তে মাটিতে মিশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এতো বড় একটা কারখানা চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। কারখানার শেডগুলো খসে পড়ে যাচ্ছে। অথচ দেখার কেউ নেই। আখ চাষি জালাল মন্ডল আক্ষেপ করে বলেন, লোকসান জেনেও আমরা জমিতে আর্থিক ফসল আখচাষ করি। তবে মিলের হয়রানি আর ভোগান্তির কারণে আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কৃষকরা। তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো যেখানে টাকা ছাড়াও সার ও বীজসহ সব রকম সাহায্য করে চাষিদের। অথচ চিনিকল কর্তৃপক্ষ তার উল্টো। সেজন্যই এ মিলের এই দুরবস্থ। শ্রমিক নেতা সাগর আহমেদ বলেন, কোনো শ্রমিক কখনো চাইবে না তার কর্মপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাক। এখানে কেবলমাত্র শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকলেই চলবে না। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। চিনিশিল্প কর্পোরেশনকে আন্তরিক সুদৃষ্টি দিতে হবে

বন্ধ হয়ে যাওয়া কুষ্টিয়া চিনিকলের দেখভালের দায়িত্বরত (কারখানা ইনচার্জ) হাবিবুর রহমান সব সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা কারণে কারখানা ভবনের এই জরাজীর্ণতার কথা চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। উনারা কয়েকবার এসে পরিদর্শনও করে গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো মেরামতের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অর্থ বরাদ্দ পেলেই ভেঙে যাওয়া বা উড়ে যাওয়া চালাসহ ভবন সংস্কার করা হবে।

মূলত চিনিশিল্প কর্পোরেশনের দায়িত্বহীনতার ফলে প্রতি বছরই উৎপাদিত চিনি গুদামজাত থেকে অবিক্রিত থাকায় একদিকে শ্রমিক তার বকেয়া বেতন, বোনাস ও ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। অন্যদিকে কৃষক তার আখের দাম পেতে হয়রানির মুখে পড়ায় আখচাষে নিরুৎসাহিত হয়। আবার অর্থসংকটে মিলের সংস্কারকাজও আটকে যাওয়াসহ সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত শংকায় দিন কাটছে কুষ্টিয়া চিনিকলের। ধ্বংসের পথে শেষ সময় পার করছে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।