কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে ৭ মাসের মধ্যে বয়ে যায় দুটি ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ ও ‘রিমাল’। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হামুনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এখনো এর ক্ষত শুকায়নি। এর মধ্যে গত মাসের ২৫ মে আবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’।
প্রতি বছরই হামুন ও রিমালের মতো ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুযোর্গের শিকার হচ্ছে কক্সবাজার উপকূলের বাসিন্দারা। গত বছরের ২৫ অক্টোবর হামুনের আঘাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে। ঝড়ের বেগে উপড়ে যায় মানুষের ঘরবাড়ি। ভেঙে পড়ে গাছপালা। এ সময় ওই গ্রামের লোকজন প্রাণ রক্ষার্থে দিগি¦দিক ছুটতে থাকে। বিধ্বস্ত হয় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো।
ঝড়ের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত গ্রামটির চিত্র তুলে ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য স্বপন বড়ুয়া বলেন, ‘হামুনে এই গ্রামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। ঝড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পেরে দুর্যোগে প্রায় সময় প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।
স্বপন বড়ুয়া বলেন, ‘সম্প্রতি দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মাল্টি সেক্টর প্রকল্পের (ইএমসিআরপি) আওতায় চারতলা বিদ্যালয় কাম দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এতে আশ্রয়কেন্দ্রটি পূর্ব রাজারকুলের মতো দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বর্ষায় এ অঞ্চলে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। নতুন আশ্রয়কেন্দ্রটি দুর্গতদের আশ্রয়ের ঠিকানা। এলাকার হাজারো মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও আশ্রয় পাবে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।’ পূর্ব রাজারকুল গ্রামের মতো দৃশ্য পাল্টে গেছে উখিয়া উপজেলার দরগাহ বিল, দরগাহ পালং, টাইপালং, ডেইলপাড়া, হাতিমুড়া, লম্বাঘোনা, শৈলডেবা, ডিগলিয়া পালং, ডেইল পাড়া, চাকবৈঠা, গয়াল মারা, আমতলী, ভালুকিয়া, তুলাতুলিসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের। এসব গ্রামে এখন দুযোর্গ-দুর্বিপাকে আশ্রয় নেওয়ার জন্য মানুষ পাকা আশ্রয়কেন্দ্র পেয়েছে।
বাশেঁর সাঁকো থেকে ব্রিজ কালভার্ট : দীর্ঘদিন ধরে উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের শৈলেরডেবা গ্রামের হাজারো মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা ছিল বাঁশের সাঁকো। ছিল কাঁচা রাস্তা। এতে বৃষ্টিবাদলে মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। এখন সেই দিন বদলেছে। গ্রামজুড়ে পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় শৈলেরডেবার সঙ্গে আশপাশের গ্রামের সংযোগের জন্যে সেখানে ৪২ মিটার লম্বা আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ১০ কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিং দ্বারা উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া ১০টি কালভার্ট, ১৪টি সৌর বিদ্যুতের সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ূন কাদের বলেন, সাঁকো দিয়ে চলাচলের সময় গ্রামের লোকজন নানা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসছিল। কোনো অসুস্থ রোগী, শিক্ষার্থী ও জরুরি কাজে যাতায়াতে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতো। এখন রাতবিরাতেও গাড়িযোগে গ্রামে আসা-যাওয়া করা যায়।
দীপ্তি বড়ুয়া বলেন, ‘এক সময় দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কোথাও আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন গ্রামেই আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়েছে।
গ্রামের রাজেমা খাতুন পাকা রাস্তা পেয়ে মহা খুশী তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাট পাকা হওয়ায় ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে। রাতেও রাস্তাঘাট সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত থাকে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম (বিসিসিপি) এর মাধ্যমে জানতে পেরেছি সেবা সুবিধা আমার, যত্নে করি ব্যবহার। তাই সরকারের দেয়া এসব সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে।’ টাইপালং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুদি দোকানদার মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘আগে ব্রিজটি না থাকায় আমাদের প্রায় ২ কিলোমিটার পথ ঘুরে আসতে হতো। এখন সেতুটি পার হলেই হয়। গাড়িযোগে যাতায়াত করতে পারি।’ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : ইএমসিআরপি প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো হচ্ছে, বিদ্যালয় কাম দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র ৫০টি, বহুমুখী কমিউনিটি ও সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ ৩৪টি, রাস্তার উন্নয়ন ২৩৭ দশমিক ৩৮কিলোমিটার, মাঠ পর্যায়ের অফিসের সংস্কারসহ সম্প্রসারণ একটি, রাস্তা মজবুত ও প্রশস্তকরণ ৪২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ফুটপাত, ড্রেনেজ সুবিধা নির্মাণ এবং পার্শ্ব ঢাল সুরক্ষা ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার, আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ৩৭১ মিটার, রাস্তার পাশের ড্রেন নির্মাণ ২০০০ মিটার, হাটবাজারের উন্নয়ন ৬টি, ত্রাণ প্রশাসন ও বিতরণ কেন্দ্র নির্মাণ একটি, সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন ৪০০০টি, বজ্র নিরোধক সুরক্ষা সিস্টেম সরবরাহ এবং স্থাপন ৯৭৫টি, বিভিন্ন রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ ২০ কিমি. রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং উন্নয়ন ২৬৫ মি. জেটি উন্নয়ন ১৫৫০ মি. সোলার পিডি ন্যানো গ্রিড সরবরাহ ও স্থাপন ১০০টি, উখিয়া ও টেকনাফে বিদ্যমান ফায়ার সার্ভিস অফিসের উন্নয়ন দুটি, কক্সবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জন্য ভবন নির্মাণ একটি, কক্সবাজারে এলজিইডি ভবনের উন্নয়ন ১টি, প্রশিক্ষণ সুবিধা নির্মাণ একটি। এছাড়াও এই প্রকল্পের অধীনে গভীর নলকূপ স্থাপন, পানির রিজার্ভার নির্মাণ, ওয়াটার পয়েন্ট বা ট্যাপস্ট্যান্ড নির্মাণ, পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয়, সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে ‘ইএমসিআরপি’ এর আওতায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি) এই প্রকল্পের কমিউনিকেশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়মিত কমিউনিটি ভিত্তিক নানান কার্যক্রম পরিচালিত করছে।
এলজিইডি কক্সবাজারের নিবার্হী প্রকৌশলী মো. মামুন খান বলেন, ‘আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় পর্যায়ে এলজিইডি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জেলায় স্থানীয়দের জন্য ২৬৮ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন ও পুনঃসংস্কার কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৯০ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। উখিয়া উপজেলায় নির্মিত ৪টি ব্রিজ, ৪৫টি বিদ্যালয় কাম দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার-মহেশখালী নৌরুটের গোরকঘাটায় একটি আধুনিক জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি রাবারড্যামের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সার্ভিস সেন্টার, স্যাটেলাইট ফায়ার সার্ভিস সেন্টার, ২৬৮টি বজ্রনিরোধক যন্ত্র সোলার বিদ্যুৎ প্যানেল, এনার্জি সেক্টরে ২ হাজার ৫০০টি সৌর সড়কবাতি, এনার্জি সাপ্লাইয়ের জন্য ৩৫টি ন্যানোগ্রিড স্থাপন করা হয়েছে, আরো ৩৫টির কাজ চলমান আছে।