ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি

উপজেলা নির্বাচনে চার ধাপে ছিল নতুনদের জয়জয়কার

উপজেলা নির্বাচনে চার ধাপে ছিল নতুনদের জয়জয়কার

চলমান ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম চার ধাপের ৪৪২ উপজেলায় নতুনদের জয়জয়কার দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে তিন পদের ভোটে ১ হাজার ২১০ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৯৩০ জনই নতুন মুখ। মাত্র ২৭৯ জন জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা পঞ্চম উপজেলা পরিষদে বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে দুর্নীতি বিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হলফনামা বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত ফলাফল’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। টিআইবি বলেছে, ৪৪২ উপজেলার মধ্যে ৩০৩ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নতুন মুখ নির্বাচিত হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে নবনির্বাচিত মুখ ৩১৭ জন। বিগত পঞ্চম উপজেলা পরিষদে ছিলেন ৬৫ জন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩১০ জন নতুন মুখ। ৮৪ জন নারী ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, যারা গত উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে তিন পদে মোট প্রার্থী ছিলেন ৫ হাজার ৪৭২ জন। চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ৮৬৪ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ হাজার ৯৫ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে অংশগ্রহণ করেছেন ১ হাজার ৫১৩ জন।

আইন অনুযায়ী, দলীয় প্রতীকে ভোটের বিধান থাকলেও নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। মন্ত্রী-এমপিদের ভোটে স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও দলীয় নিয়ম অমান্য করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের ৫৪ জন স্বজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

এদিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ১৩১ উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এতে বহিষ্কৃত হয়েছেন ২০১ জন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৭৬ জন, যার মধ্যে ১৪ জন জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন।

নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেশি; নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের অধিকাংশ নিম্ন মাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন।

জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের সব ধাপে ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণ্ণ আছে বলে মনে করে টিআইবি। তাদের তথ্য মতে, ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৮ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের হার ৫ বছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ; চেয়ারম্যানদের প্রায় ৭৯ শতাংশই ব্যবসায়ী।

নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫০ দশমিক ৯৬ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী/গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। গৃহিণী/গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে। নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ।

আইনি সীমা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ২৫ জন। আইনি সীমার বাইরে সর্বমোট জমির পরিমাণ ৮৭৪ একর। আইনি সীমার বাইরে জমি আছে সাত বিজয়ীর।

সার্বিকভাবে প্রার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ শতাংশ প্রার্থী।

চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে বলে জানায় টিআইবি। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ শতাংশের আয় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার ওপরে, অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ হার ৩.০৩ শতাংশ। আবার, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫০ দশমিক ২৫ শতাংশ। বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ২৮০ জন। চেয়ারম্যানদের ৫১ শতাংশ বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন। বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ৪০। এর মাঝে দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান আর বাকি সবাই চেয়ারম্যান। ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ৩৯০ প্রার্থীর কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে। ৫ বছরে প্রায় তিনগুণের বেশি হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা। নির্বাচিতদের ১৫০ জন বা ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কোটিপতি; চেয়ারম্যানদের ১৩২ জন বা ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ কোটিপতি। প্রায় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১ হাজার ৩৩৫ জন প্রার্থীর ঋণ/দায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৫২৮ দশমিক ৯১ কোটি টাকা ঋণ/দায় আছে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর। গত নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে দায় বা ঋণগ্রস্তের সংখ্যা; নতুন চেয়ারম্যানদের প্রায় ৪৪ শতাংশের বর্তমানে ঋণ আছে।

গত ৫ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩১ হাজার ৯০০ শতাংশ; এ সময়ে জনপ্রতিনিধিদের স্ত্রী অথবা স্বামী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। একজন সংসদ সদস্যের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ।

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদে একজন বিজয়ীর ৫ বছরে আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ; অস্থাবর সম্পদ সর্বোচ্চ বেড়েছে ২৩ হাজার ৯৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রার্থীর হলফনামার সঙ্গে আয়কর রিটার্নের সম্পদের হিসেবের পার্থক্য দেখা যায়। নারী ও পুরুষ প্রার্থীদের প্রায় প্রত্যেক নির্দেশকে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য দেখা যায়; প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিলেন নারী প্রার্থীরা।

গত ৫ বছরে ১ কোটি টাকার উপরে অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৫১ জন। ১০ বছরে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৪১ জন। দেশের মধ্যাঞ্চল, কুমিল্লা-ফেনী অঞ্চল ও খুলনা অঞ্চলে প্রার্থীদের গড় আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেশি। বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা অঞ্চলে প্রার্থীদের গড় অস্থাবর সম্পদ ৫ বছরে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গাজীপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলে।

১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বা ৮৫৮ জন প্রার্থী বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত আছেন। অতীতে অভিযুক্ত ছিলেন ১ হাজার ১০৯ জন বা ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

বর্তমানে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা সাতজন, একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর সর্বোচ্চ মামলা চলছে ২৭টি; অতীতে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০ জন, পূর্বে সর্বোচ্চ ২৭টি মামলা ছিল একজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর।

প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রধানত আঘাত, জনগণের শান্তিভঙ্গ, ভীতিপ্রদর্শন, অপমান, উৎপাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদি ধরনের মামলা বর্তমানে আছে বা আগে ছিল।

প্রসঙ্গত, দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯৫টি। এবার চার ধাপে উপজেলা পরিষদ ভোটের ঘোষণা দিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কমিশন তা আর করতে পারেনি। চার ধাপে ৪৪২ উপজেলায় ভোট শেষ করে কমিশন। গতকাল ১৯ উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হয়। সব মিলিয়ে ৪৬১ উপজেলায় ভোট শেষ হলো গতকাল। আইনি জটিলতা ও মেয়াদ শেষ না হওয়ায় বাকি ৩৪ উপজেলায় পরে ভোট হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত