‘পরীক্ষার ফল দিয়ে জীবনের ফল নির্ধারিত হয় না। অকৃতকার্য হওয়ার কারণকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।’ গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে দিনব্যাপী চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন বাংলাদেশ (কেআইবি) অডিটোরিয়ামে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দুই শতাধিক অকৃতকার্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্টদের মতামত শোনা এবং এ বিষয়ে গুণীজন ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেশের ১০ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের অংশগ্রহণে এ আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, পরীক্ষায় যারা কৃতকার্য হয় নাই তাদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নাই। এমন হতেই পারে। পরীক্ষার ফলই সব না। অনেকেই জীবনে ব্যর্থ হয়েছে, পরে আবার সফল হয়েছে। এখন যা করতে হবে তা হলো- মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য তিনটা বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। একটা হচ্ছে, না বুঝে মুখস্ত করবে না। আরেকটা হলো, যেটা পড়বে সেটা বুঝার চেষ্টা করবে। আর তৃতীয়টা হচ্ছে, না বুঝলে চিন্তা করবে, বুঝলে না কেন? প্রয়োজনে শিক্ষক ও অভিভাবকের সহযোগিতা নেবে। এবিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলে সবাই পাসতো করবেই, শিক্ষাটাও পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হবে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘এবার এসএসসি পরীক্ষায় একটু বেশি ফেল করেছে। ৫১ প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করতে পারেনি, যা খুবই দুঃখজনক। তাই বলে মনোবল হারানো যাবে না। সবাইকে মনোবল বাড়াতে হবে। আবার পরীক্ষা দিয়ে নবাইকে পাস করতে হবে।’ আমরা আগাচ্ছি নাকি পেছাচ্ছি- এমন প্রশ্ন রেখে সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সংকট আছে, ইচ্ছা করলেই সব পারা যায় না। এরপরও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভালো শিক্ষা ও ভালো মানুষ চাই।’
কথাসাহিত্যিক ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের পড়াশোনার সিস্টেম ভালো না। আমরা শুধু পরীক্ষা নিতে পারি। এবার আমাদের ৩ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। আমরা চাই এই ৩ লাখ শিক্ষার্থী যেন আবার পরীক্ষা দেয় এবং সবাই যেন সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়- এমন প্রত্যাশা করছি। একটু কষ্ট করলে সবাই পাস করবে।
কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, পরীক্ষার ফল দিয়ে জীবনের ফল নির্ধারিত হয় না। আমাদের ভালো ছাত্র দরকার, একথা ঠিক। কিন্তু যারা বিভিন্ন কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে, তাদেরকে নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এখানে যারা অংশগ্রহণ করেছে, তারা অকৃতকার্য হওয়ার কারণকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে, সেটাই কামনা করি।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, গণস্বাক্ষরতা অভিযান কোনো প্রথাগত এনজিও নয়। এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন, যেটি মূলত ২৩০টি সংগঠনের সমন্বয়ে মোর্চা। আমরা বিভিন্ন সময়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেছি। আজকের এই উদ্যোগ তারই অংশ। যারা এই সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতা করেছে, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী। এছাড়া সহ-সঞ্চালক ছিলেন চ্যানেল আইয়ের বিশেষে প্রতিনিধি মোস্তফা মল্লিক এবং উপস্থাপিকা শাকিলা মতিন মৃদুলা।
এ সময় পঞ্চগড় জেলা থেকে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার কারণ বর্ণনা করে বলেন, আমি এক সাবজেক্ট ‘এ’ এবং বাকি সব বিষয়ে ‘এ’ প্লাস পেয়েছিলাম। কিন্তু কেমেস্ট্রিতে ফেল করি। যদিও অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে কি কারণ ছিল, সেটি এখনও বুঝতে পারিনি। আমি সে সাবজেক্টে ভালো পরীক্ষাও দিয়েছি। আমি চাই ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরেও ফেল করার কারণ উদ্ঘাটন করে আমাদের সহযোগিতা করা হোক।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমি ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছি। বাবা এবং মা কৃষি কাজ করেন। আমারও তাদের কৃষি কাজে সহযোগিতা করতে হয়। আমি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকদের লেকচার স্পষ্ট বুঝতে পারতাম না। যে কারণে পরীক্ষায় ফেল করি। আমার মতো অন্য যারা আছেন, তাদের জন্য আমাদের নৃগোষ্ঠী থেকে গৃহশিক্ষক কিংবা স্কুলে শিক্ষক পেলে আমাদের পরবর্তীতে পরীক্ষায় ভালো করা সহজ হবে।
সকালের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খালেকুজ্জামান আহমদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, কথাসাহিত্যিক ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান, সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দ এবং এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। এছাড়া বিকালের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য এম এ মান্নান, আরমা দত্ত, শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী ও নকিব খান এবং এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদার।