পরিকল্পিত উন্নয়নে সমৃদ্ধির পথে ভোলার অর্থনীতি 

* প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টানছে পর্যটক  * সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রাহাত হুসাইন, ভোলা থেকে ফিরে

দেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলা। এ জেলার পরতে পরতে রয়েছে পর্যাটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ গ্যাস আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভোলার অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জন্য সৌন্দর্য কাজে লেগেছে। প্রকৃতিক সৌন্দর্য টানছে পর্যটক। পর্যটনশিল্প ভোলাকে ‘কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত করছে।

সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে ভোলা জেলার পর্যটন স্পষ্টগুলো ক্রমশ স্পষ্ট ও উন্নত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়ন ও পরিকল্পরায় সমৃদ্ধির পথে হাটছে দ্বীপজেলার অর্থনীত। ভোলায় রয়েছে একাধিক দ্বীপ বা চর। এ দ্বীপগুলো ভোলার পর্যটনশিল্পের প্রাণভ্রমরা। স্থানীয়দের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অন্যতম ভূমিকা রাখছে পর্যটন স্পষ্টগুলো। এরই মধ্যে জেলার দক্ষিণে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুকরি-মুকরি, মনপুরার এবং জ্যাকব টাওয়ারের নাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া রয়েছে লাল কাঁকড়ার জন্য বিখ্যাত ঢাল চরের তারুয়া সমুদ্রসৈকত। ভোলায় গেলে দেখা মিলছে সাগর-নদী ও সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বন। দূর-দূরন্ত থেকে দ্বীপজেলার রূপ-লাবণ্য দেখতে আসছেন মানুষজন। পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠায় এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বহুমুখী কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা চর কুকরি-মুকরি ‘দ্বীপকন্যা’ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। এই দ্বীপচরের একদিকে সাগর-নদীর মোহনা আরেক দিকে সবুজের আচ্ছাদন- যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার মহিমা। জলরাশিবেষ্টিত এই দ্বীপ দেশের অন্যতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবেও সুপরিচিত। এখানকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল যেন আরেক সুন্দরবন। চর কুকরি মুকরির বনভূমিতে স্থান পেয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, ছৈলা, কেওড়া, নারিকেল, বাঁশ ও বেত। জীববৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বানর, শিয়াল, বুনো মহিষ, বন মোরগ ইত্যাদি। দ্বীপকন্যা তার মায়াবী স্নিগ্ধতা বিমোহিত করে রেখেছে চারপাশ। নদী-সমুদ্রের সৌন্দর্যের পাশাপাশি সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়, এখান থেকে, যা মুগ্ধতা ছড়ায় পর্যটকদের মধ্যে। ভ্রমণপ্রেমি মানুষের কাছে দিন দিন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এই দ্বীপ। চর কুকরি-মুকরির বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ভাড়ানি খাল মেঘনা নদী হয়ে আছড়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। ভোলা সদর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরের অবস্থিত চর কুকরি মুকরি। চর ফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা থানার চর কচ্ছপিয়া থেকে স্পিডবোট কিংবা ট্রলারে করে মাঝারি খালের মধ্য দিয়ে কুকরি মুকরি যেতে হয়। যাওয়ার সময় দুই পাশের ম্যানগ্রোভ বন দেখে সুন্দরবনের অবয়ব ভেসে ওঠে। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ নদী এবং সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আমির মোল্লা বলেন, চর কুকরি-মুকরিতে বিভিন্ন সময় মানুষজন আসেন। অনেকে পিকনিক করেন। তাবু টানিয়ে রাতে থাকেন। নদী-সমুদ্র, হরিণ-বানর দেখতে আসেন। কোনো সমস্যা হয় না। শীতকালে আরো বেশি সুন্দর দেখায়। তখন বিভিন্ন জাতের পাখি দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়া ভোলার বাংলাবাজার এলাকায় রয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। দ্বীপবাসী নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। স্বাধীনতা জাদুঘরটি খুবই নান্দনিকভাবে সাজানো। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে এ জাদুঘরে। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘরও ভোলায়। শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে আলীনগর ইউনিয়নের এটি অবস্থিত। ভোলা শহরের উকিল পাড়ায় রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত নিজামণ্ডহাসিনা মসজিদ।

জেলার চর ফ্যাশন উপজেলার রয়েছে একাধিক পর্যটনস্পট। তার মধ্যে অন্যতম হলো- মেঘনা নদীর পাড়ে গড়া ওঠা বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক। এ পার্ক দর্শনার্থীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের আনাগোনা সব সময় লেগেই থাকে। আরো রয়েছে, ১৮ তলাবিশিষ্টি ‘জ্যাকব টাওয়ার’। লিফটের সাহায্যে নিচ থেকে উপরে উঠার সুযোগ রয়েছে। এখানে উঠলে পুরো পৌর শহর দেখায় যায়। চোখে পড়ে সবুজে ঘেরা ভোলা। জ্যাকব টাওয়ারের পাশে রয়েছে ফ্যাশন স্কয়ার ও পানির ফোয়ারা এবং শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক। সুউচ্চ জ্যাকব টাওয়ারের অপর পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন চর ফ্যাশন কেন্দ্রীয় খাসমহল মসজিদ। স্থাপত্যশৈলী ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় নির্মিত হয়েছে এ মসজিদটি। চারতলা বিশিষ্ট এই মসজিদের আয়তন ৫৩ হাজার ২ শত বর্গফুটের। এই মসজিদে একসাথে সাড়ে ৪ হাজার মুসল্লির নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে।

জানতে চাইলে চর ফ্যাশন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, উপকূলের এ অঞ্চলে একদিকে বঙ্গোপসাগর-মেঘনা নদী, আরেক দিকে বুড়া গৌরাঙ্গ ও তেতুলিয়া নদী। উপকূলজুড়ে রয়েছে বনভূমি। এই উপকূল অঞ্চলের মানুষ জীবন-জীবিকা পর্যটকদের জন্য একটা বিশেষ আকর্ষণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে ভোলা জেলায় পর্যটকদের আগমন আগের থেকে বেড়েছে। বিশেষ করে এই চর ফ্যাশন উপজেলায়। এছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যটনশিল্প এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির আরো একটা সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। পর্যটনশিল্প বিকাশে আমাদের আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। উপকূলের এই অঞ্চলে ইকো ট্যুরিজমের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উপকূল অঞ্চলের পর্যটনশিল্প বিকাশে সরকার একটা মহাপরিকল্পনা করেছে।

ভোলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আরিফুজ্জামান বলেন, ভোলা দেশের অন্য জেলা থেকে স্বতন্ত্র। এর চারপাশ নদী দ্বারা বেষ্টিত। এ জেলায় অসংখ্য ছোট ছোট চর রয়েছে। এই চরগুলো ঘিরে পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা ভোলার পর্যটনের ক্ষেত্রগুলোকে উন্নত ও আরো পর্যটন উপযোগী করা। এর মাধ্যমে ভোলা জেলা ও দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হবে।