কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে টুং-টাং শব্দে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারওয়ান বাজারের কামারশালার কামারিরা। ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। বিক্রি বাড়ছে ছুরি-চাপাতিসহ পশু কাটাকাটির কাজে ব্যবহার করা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কামারপট্টি ঘুরে দেখা যায়, কোরবানির ঈদ ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কামাররা। টুং, টাং শব্দে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তপ্ত লোহা পিটিয়ে ছুরি, চাপাতি, দা, বঁটি, কুড়াল, জবাই ছুরি, রেতসহ বিভিন্ন ধারালো যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন তারা। প্রায় ১২টি কামার ঘরেই চলছে এমন কর্মযজ্ঞ। এ কামারঘরগুলো ঘিরে সামনে রয়েছে আরও ২৫টির মতো দোকান। সেসব দোকানে ক্রেতাদের জন্য থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম। কিছুক্ষণ পর পর ক্রেতারা এসে প্রয়োজনীয় ছুরি-চাপাতি দেখছেন, যাচাই-বাছাই করে কিনছেনও। তারা বলছেন, সাধারণ সময়ের তুলনায় বেচা-কেনা বেড়েছে। তবে কোরবানির ঈদ ঘিরে এখনও গত বারের মতো ক্রেতা আসছে না। জনতা ট্রেডার্স অ্যান্ড নোয়াখালী হার্ডওয়্যারের বিক্রেতা মানিক বলেন, রোজার ঈদের পর থেকেই তারা কোরবানির ঈদের জন্য ছুরি-চাপাতি তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রতিদিন কামাররা ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে ক্রেতার চাহিদামতো ছুরি-চাপাতি তৈরি করেন। একই জিনিস বিভিন্ন ধরনের লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়। তাই দামের পার্থক্য হয়। কোনোটা বেশি, কোনোটা কম। রেতের জবাই ছুরি আর গাড়ির পাতির (লোহা) ছুরি এক নয়। দামও ভিন্ন। ক্রেতাদের দেখে-শুনে সেগুলো কিনতে হবে।
বিক্রেতারা জানান, এ বছর মান ভেদে ৬০০-৮০০ টাকা দরে প্রতি কেজি চাপাতি, দা, বঁটি বিক্রি হচ্ছে। অনেক সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে পিস হিসেবে। তার মধ্যে ছোট ছুরি ১৫০-৩০০ টাকা, কুড়াল ৭০০-৮০০ টাকা, জবাই ছুরি ৬০০-৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন কেরানীগঞ্জের কামারশালার কামারিরা। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। তবে সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কয়েকগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কামারদের। তবে এ বছর ঈদে কামারদের মুখে তেমন কোনো হাসি নেই। কারণ চায়না থেকে মাল আসা, লোহা, কয়লা ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায়।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইউনিয়নের তাওয়াপট্টি কামারশালাগুলো ঘুরে কয়েকজন কামারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চায়না মালের জন্য আমাদের এ ব্যবসার ধস নেমেছে। আমাদের একটা চাপাতি তৈরি করতে যেখানে খরচ হয় ১ হাজার টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। সেখানে চায়না চাপাতি কিনতে পাওয়া যায় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। এরপর ঈদ মৌসুম এলেই লোহা ও কয়লার দাম ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায়। তাই আমাদের এখন মাল তৈরি করে পোষায় না। আবার অনেক সময় টাকা থাকে না তখন বড় বড় পাইকারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কাঁচামাল কিনে দা, বঁটি, ছুরি বানিয়ে তাদের বাজার থেকে কম দামে দিতে হয়। এসব দা, বটি, ছুরির দাম জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, দা ছোট ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা, বটি বড় ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা, পশু জবাইয়ের ছুরি ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, চাপাতি ৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা বিক্রি হয়। আপনাদের তৈরিকৃত মাল সব বিক্রি না হলে পড়ে এগুলো কি করেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে ইমামগঞ্জ। দেশের সবচেয়ে বড় হার্ডওয়ারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেখানে বিক্রি করে দেই।
জানা যায়, পশু জবাইয়ের সরঞ্জামাদি কিনতেও লোকজন ভিড় করছেন কামারিদের দোকানে। আগে যেসব দোকানে দুজন করে শ্রমিক কাজ করত, এখন সেসব দোকানে ৫-৬ জন করে শ্রমিক কাজ করছেন। ক্রেতাদের অভিযোগ ঈদ উপলক্ষে দা, চাপাতি ও ছুরির দাম বেশি নেওয়া হয়। ছুরি শান দেওয়ার জন্য ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে কামার দোকানদারদের অভিযোগ কোরবানির ঈদ উপলক্ষে লোহা, কয়লার ও শ্রমিকদের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের তৈরি মালের দাম একটু বেশি।
আগানগর এলাকা থেকে দা, বটি ও ছুরি কিনতে আসা মো. শাজাহান বলেন, কেরানীগঞ্জের কামারশালার কারিগরদের হাতের কাজ খুব নিখুঁত। এদের তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে খুব আরাম। আমি প্রতিবছরই কিছু না কিছু দা, বঁটি কিনে নিয়ে যাই। কারণ এসব দা বঁটি কোরবানির ঈদের পরে আর কেউ এগুলোর খবর রাখে না তাই খোঁজাখুঁজি না করে নতুন কিনে নিয়ে যাই। নান্টু নামের এক কামার জানান, আগে কোরবানির ঈদ আসলে আমাদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যেত।