রংপুর অঞ্চলের হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ন্যায্য দাম না পেয়ে চামড়া মাটিচাপা দিয়েছেন অনেকে। রংপুর নগরীর হাজীপাড়ার ঐতিহ্যবাহী চামড়া পট্টিতে ছিল না কোনো হাঁকডাক। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরো চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে নেন আড়তদারসহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সন্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। দাম না পাওয়ায় এবার চামড়া অনেকেই মাদ্রাসা ও মসজিদে দান করে দিয়েছেন। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কোনো প্রভাব পড়েনি। মিঠাপুকুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বুজরুক হরিপুর গ্রামের মো: আমরুল ইলমাম ৭ হাজার টাকা দামের একটি খাসি কোরবানি দিয়েছিলেন। চামড়ার দাম না থাকায় তিনি ওই খাসির চামরা মাটিতে পুঁতে ফেলেন। এরকম শত শত আমরুল চামড়ার দাম না পেয়ে খাসির চামরা মাটিতে পুঁতে ফেলেন।
চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের দাবি, সিন্ডিকেট রংপুরের মতো মফস্বল পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। এছাড়া শ্রমিকের মজুরির কারণে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
নগরীর শালবন এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী আশরাফ জানান, বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে এবার প্রায় দুই শতাধিক পিস চামড়া সংগ্রহ করেন। রাতে সেই চামড়া নিয়ে নগরীর হাজিপাড়া চামড়া আড়তে বিক্রির জন্য আসলে ৩০ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে তাকে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে। আড়তদাররা চামড়া কিনতে রাজি না হওয়ায় তাকে মোটা অঙ্কের লোকসান মেনে নিতে হয়েছে।
সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী জানান, রংপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের কারণে বাইরের ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এটার প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে। রংপুরের চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, তারা নিজেরাও সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে থাকেন। চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের দেন। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন ট্যানারি মালিকের কাছে এখন অনেকেই জিম্মি। কয়েক বছর ধরে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।রংপুরের বাইরে আড়তদারদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হাজীপাড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি এবং জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি। এখন তা নেই। চামড়া ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, তৌহিদ ইসলাম ও কুতুব উদ্দিন জানান, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা জানান, ভালো মানের গরুর চামড়া হাজার টাকা পর্যন্ত কিনেছেন। এসব চামড়া লবণজাত করতে হলে শ্রমিকসহ আলাদা খরচ রয়েছে। সবমিলিয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কাছাকাছি মূল্যেই তারা চামড়া কিনেছেন। রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফজাল হোসেন জানান, ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম বেড়েই চলেছে। ছোট ছোট চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয় না। ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিক ট্যানারির মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি চালু রয়েছে। রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এনামুল হক জানিয়েছেন, এবার রংপুর মহানগরীসহ পুরো জেলাতে দুই লাখের বেশি গরু কোরবানি হয়েছে। খাসি হয়েছে প্রায় লাখের কাছাকাছি। কোরবানির পশুর এসব চামড়া স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সংগ্রহ করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বা আড়তে পৌঁছে দেন। বিসিক রংপুর জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) এহেছানুল হক জানান, কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে বিসিক বিনামূল্যে লবণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যেসব বেসরকারি মাদ্রাসা ও এতিমখানা কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ করবে, সেসব মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিনামূল্যে লবণ বিতরণ করা হয়েছে। বিসিক রংপুর জেলা কার্যালয় ১৫ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ কেজি লবণ বিতরণ করেছে। রংপুর জেলায় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন ২ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন লবণ।