চট্টগ্রামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চামড়া সংগ্রহ

* ৩ লাখ ৬১ হাজার পশুর চামড়া সংগ্রহ

প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

পবিত্র ঈদুল আজহা গত হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। এ কোরবানির ঈদের পরে পশুর চামড়া আলোচনায় থাকে। চামড়া শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ী, ট্যানারিমালিকসহ সবাই এ সময় থাকেন মহা ব্যস্ততায়। চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে আগের সেই টানাটানি বা এলাকাভিত্তিক উত্তেজনা এখন আর নেই। কয়েক বছর ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পর অনেকেই মৌসুমি এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে গত দুই বছর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারাদের দেখা মেলেনি। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এ বছর স্বল্প সংখ্যায় হলেও তাদের অনেকের দেখা মিলেছে। আড়তদাররা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে এ বছর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সামান্য বেশি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। কোরবানির দিন গত সোমবার দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আড়তদারের প্রতিনিধি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন যানবাহনে করে চামড়া নিয়ে আসেন আতুড়ার ডিপো এলাকায়। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০-৯০ শতাংশ পূরণ হয় কোরবানির ঈদে জবাই করা পশু থেকে। ফলে এটাই চামড়া সংগ্রহের মৌসুম। কোরবানির দিন ও তার পরে আরো দুই দিনসহ মোট তিন দিন কোরবানির পশু জবাই করেন মুসলামনরা। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে সেসব পশুর চামড়া কিনে নেন মৌসুমি ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারা। বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার লোকজনও সেসব চামড়া দান হিসেবে সংগ্রহ করেন। পরে সেগুলো বিক্রি করা হয় পাইকার বা আড়তদারদের কাছে। আড়তদাররা সেই চামড়া কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করে। ২০২১ সালে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা মিললেও তারা আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই চামড়া কিনেছিলেন। পাশাপাশি গত দুই বছরের মতো এবছরও বিভিন্ন এলাকা থেকে গাউসিয়া কমিটি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছে। এ বছর গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা চামড়া সংগ্রহ করলেও কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী আর ফড়িয়ার দেখা মিলেছে ঈদের দিন। চট্টগ্রাম নগরীতে ঈদের দিন সকালে পশু কোরবানির পর মাদ্রাসার প্রতিনিধি, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে যে চামড়া সংগ্রহ করে তা দুপুর থেকে নিয়ে আসেন নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায়। আড়তদারের প্রতিনিধিরা সেসব চামড়া কিনে নেন। গত কয়েক বছর সেখানে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কম থাকলেও এবছর সে সংখ্যা কিছুটা বেশি দেখা গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন জানান, তারা এবার সাড়ে তিন লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সেখানে প্রায় ৩ লাখ ৬১ হাজার পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। যার মধ্যে গরুর চামড়া ২ লাখ ৯৭ হাজার ১৫০টি, মহিষের ১২ হাজার ২০০টি এবং ছাগলের চামড়া ৫১ হাজার ৬০০টি। আরো কয়েকদিন চামড়া সংগ্রহ চলবে। সেক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ আরো বাড়বে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদাররা ‘সিন্ডিকেট’ করে চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছেন। তবে পাইকাররা তা মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা না জেনে বুঝে অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনেছেন, সে কারণে লোকসানে পড়েছেন। তিনি আরো জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর আমাদের সংগ্রহ হয়েছে বেশি। কোরবানির তিন দিন পর্যন্ত এসব চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের পর এবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হবে। সরকার ট্যানারি ব্যবসায়ীদের জন্য যে দর বেঁধে দিয়েছিল, তাতে এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় কেনার কথা তাদের। সেই হিসাবে ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১২০০ টাকা, ঢাকার বাইরে হবে ১০০০ টাকা। এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, আর বকরির চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা।

ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ মৌসুমি বিক্রেতাদের : ‘ন্যায্য দাম’ না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৯ সালে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা সড়কে রাখে কোরবানির পশুর চামড়া। তাতে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এর পরের বছর মহামারি ও লোকসানের শঙ্কায় কোরবানিকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেভাবে মাঠে ছিলেন না। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী ইলিয়াছ হোসাইন অভিযোগের সুরে জানান, এবছর ‘সিন্ডিকেট’ করে আড়তদাররা চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছে এবছর তিনি ২০০টি চামড়া কিনেছেন গড়ে ৬৫০ টাকা দরে। কিন্তু সেগুলো কিছু বিক্রি করেছেন ৩৮০ টাকা করে, বাকিগুলো ১০০ টাকা দরে বিক্রি করতে ‘বাধ্য’ হয়েছেন। বিকালের পর থেকে কোনো আড়তদার আর আসেনি। রাতে ফেনী থেকে একজন এসে আমাদের চামড়াগুলো ১০০ টাকা করে কিনেছে। সেগুলো আমরা বাধ্য হয়ে বিক্রি করেছি। অনেকেই চামড়া বিক্রি না করে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। তিনি আরো জানান, গত ১৬ বছর ধরে তিনি মৌসুমি এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। গতবছর লাভ হয়েছিল মাত্র বারো হাজার টাকা। এবার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত আগ্রাবাদ মোগলটুলি এলাকার বাসিন্দা মো. আজগর। তার সঙ্গে কাজ করেন মো. সাগর। কোরবানির দিন তিনি চামড়া সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। সাগর বলেন, এবছর তারা ৫০০-৬০০ টাকা করে মোট ৪৫০টি চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। পরে সেগুলো সাড়ে তিনশ’ টাকা করে বিক্রি করতে হয়েছে। এ বছর যারা চামড়া ব্যবসা করতে নেমেছে, তারা সবাই লোকসানে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেকে চামড়া ফেলে চলে গেছে। এদিকে, রাস্তায় চামড়া ফেলে যাওয়ার বিষয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল ইসলাম জানান, বিবিরহাট এলাকায় ও আগ্রাবাদ চৌমুহুনী এলাকায় আমাদের কর্মীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে গিয়ে কিছু চামড়া রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছে। যেগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল। তবে সবমিলিয়ে এর পরিমাণ তিন থেকে চার হাজারের বেশি না। সঠিক দর না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এমন কাজ করছেন বলে জানান তিনি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির দিন রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার নষ্ট চামড়া অপসারণ করা হয়েছে নগরের বিভিন্ন স্পট থেকে।

আড়তদাররা বলছেন ভিন্ন কথা : বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, আমরা নায্য দামেই চামড়া সংগ্রহ করেছি। আমাদের যতটুকু ধারণক্ষমতা বরং তারা চেয়ে বেশি চামড়া আমরা কিনেছি। বর্তমানে চট্টগ্রামে আড়তদারের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের অনেকের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার পরও চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আমাদের প্রশাসন থেকে বারবার বলা হয়েছে যাতে চামড়া নষ্ট না হয়। সেজন্য আমরা অনেকেই অতিরিক্ত চামড়া সংগ্রহ করেছি। মুসলিম উদ্দিনের ভাষ্য, চামড়ার সরকার নির্ধারিত যে মূল্য থাকে, সেই দরে ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের কাছ থেকে কেনে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেটা না বুঝে তাদের ‘ইচ্ছেমত’ দামে চামড়া কিনেছেন। পরে আড়তে বিক্রি করতে গিয়ে চাহিদামত দাম না পাওয়ায় অভিযোগ তুলছেন। যারা পরিস্থিতি বোঝে তারা লোকসানে পড়েনি। আর যারা না বুঝে চামড়ার দাম ধরে, তারাই লোকসানে পড়েছে। তাদের এ দায় তো আমরা নিতে পারি না। সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুল কাদের বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ গরম পড়ছে চামড়া সংরক্ষণের জন্য তা অনূকূল নয়। কাঁচা চামড়া ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যেই লবণ দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার মান, ফুট না বুঝেই চামড়া কিনে ফেলে। অতিরিক্ত লাভের আশায় তারা দাম ধরে রাখে। ফলে তাদের চামড়া এক পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়।

সেগুলো আড়তদাররা আর কেনে না। আব্দুল কাদেরের দাবি, ঈদের দিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা আকারভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। কিন্তু অনেকেই অতিরিক্ত লাভের আশায় সে সময় বিক্রি না করে ধরে রেখেছিল। যার কারণে সেগুলো এক পর্যায়ে এসে নষ্ট হয়ে গেছে। পরে বাধ্য হয়ে রাতে সেগুলো তাদের আরো কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। যেটা আড়তদারদেরও ক্ষতি।

নিয়ন্ত্রণহীন চামড়ার বাজার : চামড়া বিকিকিনিতে লোকসানের মুখে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়ার দাম অনুযায়ী দরদামের বিষয়টি ভালোভাবে না বুঝার কারণে চামড়ার বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে আড়তদার সমিতির নেতা কাদের বলেন, কোরবানির ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বিক্রির সময় ট্যানারি মালিকরা কীভাবে চামড়া কিনছে সেটার নজরদারি করে না। আমাদের দাবি থাকবে সরকার যেন নজরদারি বাড়ায়। কাদেরের দাবি, একটি চামড়া সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির কাছে বিক্রি পর্যন্ত ৪৯৮ টাকা খরচ হয়। যদি ট্যানারি মালিকরা চামড়াগুলো চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে যায়, তাহলে পাইকারদের খরচ পড়বে ৩০০ টাকার মধ্যে। তাছাড়া বেশির ভাগ সময় ট্যানারি মালিকরা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কেনেন বাকিতে। সেই টাকা আদায় করা আমাদের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। টাকা আদায় করতে না পেরে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

গাউছিয়া কমিটির চামড়া সংগ্রহ : গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ চামড়া সংগ্রহের জন্য আলোচনায় ছিল গাউছিয়া কমিটি। এ বছরও তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি। বিপুল কর্মীবাহিনী নিযুক্ত করে নগরীর এবং নগরীর বাইরে থেকে চামড়া সংগ্রহ করছে গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ। কমিটির উদ্যোগে চট্টগ্রামে প্রায় এক লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। তাদের তৎপরতায় আড়তদার ও মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীদের সিন্ডিকেট ভাঙাও হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে গাউছিয়া কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। কমিটির তত্ত্বাবধানে নগরী ও উপজেলাগুলোয় চার হাজার কর্মী কাজ করেছেন। আমাদের টার্গেট ছিল এক লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ। আমরা আমাদের টার্গেট অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। এ জন্য সবার প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতাকে তিনি সাধুবাদ জানান। প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির সময় তারা রোগীদের পরিবহন, হাসপাতালে আনা-নেওয়া থেকে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে বেশ আলোচিত হয়। পরে চামড়া সংগ্রহে তৎপরতায় জনসাধারণের নজরে আসে এই স্বেচ্ছাসেবী দল।