টাঙ্গাইলে ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরবর্তী মানুষ
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল
উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি ক্রমাগত বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে জেলার দুই উপজেলার সাতটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রমত্তা যমুনার আগ্রাসী রূপে ওই নদী তীরবর্তী গ্রামের মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। গতকাল শনিবার বিভিন্ন নদীর পানি ২২ সেন্টিমিটার থেকে ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাতুলি ইউনিয়নের চরপৌলি গ্রামের অরক্ষিত ১ হাজার ৬২৫ মিটার এলাকা এবং ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের চিতুলিয়াপাড়া, ভালকুটিয়া, কষ্টাপাড়া ও নিকরাইল ইউনিয়নের মাটিকাটা, পাটিতাপাড়া, কোনাবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে তীব্রভাঙন দেখা দিয়েছে। এলাকার ভাঙন অভিজ্ঞরা জানান কয়েক দিন ধরে যমুনায় পানি বাড়ছে। ক্রমাগত পানি বাড়ার কারণে যমুনা যৌবনা হয়ে উন্মত্তরূপ ধারণের অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। যমুনা আগ্রাসী হলে কারো কিছু করার থাকবে না। মুহূর্তেই বাড়িঘর-গাছপালাসহ কাঁচা বা পাকা স্থাপনা গ্রাস করে ফেলবে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি গ্রামের কয়েক ব্যক্তি জানান, যমুনার ভাঙনে এরই মধ্যে চরপৌলি গ্রামের অরক্ষিত অর্থাৎ দুই পাশে বাঁধের মাঝখানে খোলা ১৬২৫ মিটার এলাকার ৩৫টি পরিবারের বাড়িঘর ও স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনে স্থানীয় ৩৫ পরিবারের সবাই শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বাড়িঘর হারিয়ে কেউ খোলা আকাশের নিচে কেউ অন্যের জমিতে ও বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙনকবলিতরা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য নয়, তারা যমুনার ওই অংশে বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানায়।
অন্যদিকে, ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে নদীতীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছরের ভাঙনের পর যেটুকু সম্বল বেঁচে ছিল, তাও ভাঙনের আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন পার করছে নদীপাড়ের শত শত পরিবার। এরই মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। যমুনা আগ্রাসী রূপ ধারণ করলে সবকিছু তছনছ করে ফেলবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যমুনার বামতীরে কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ী পাথরঘাট থেকে আলীপুর পর্যন্ত ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও নিউ ধলেশ্বরীর নদীর অফটেক (মুখ) বাঁধাই করা হয়েছে। অন্যদিকে, নাগরপুর উপজেলা থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলির দক্ষিণ পর্যন্ত জিওব্যাগ ও ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে চরপৌলি গ্রামের ১ হাজার ৬২৫ মিটার অংশ অরক্ষিত রয়েছে। বাঁধ না থাকায় ওই অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
নদীতীরের ভাঙন আতঙ্কে থাকা মানুষজন জানান, গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙনরোধে খানুরবাড়ী, চিতুলিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে নামে মাত্র নিম্নমানের জিওব্যাগ ফেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবার সেগুলোও ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে নিজ নিজ বাড়ির সামনে জিওব্যাগ ফেলার সুযোগ নেন। দরিদ্র পরিবারের বাড়ির সামনে জিওব্যাগ ফেলা হয় না।
গত বর্ষায় নদীভাঙনের শিকার একাধিক ব্যক্তি জানান, শুকনো মৌসুমে বালু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে নদীতে জেগে ওঠা চর কেটে ট্রাকযোগে বিক্রি করে থাকে। ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায় না বা করলেও কোনো সুফল পাওয়া যায় না।
তারা জানান, গত বছর বন্যায় ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা গাইড বাঁধের জিওব্যাগ বালু ব্যবসায়ীদের আনলোড ড্রেজারগুলোর কারণে ধসে যাচ্ছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাকা ও আধাপাকা সড়ক, গাইড বাঁধ বসতবাড়ি, মসজিদণ্ডমন্দির, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।
পাটিতাপাড়ার রহিমা বেগম, ছাহেরা আক্তার ও জোবায়ের হোসাইন জানান, যমুনা নদীতে গত কয়েক দিন ধরে পানি বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙনও দেখা দিয়েছে। কিন্তু ভাঙনরোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। গত বছর বসতভিটা ভেঙে যেটুকু থাকার জায়গা ছিল, তাও এবার চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীনের পথে।
ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামুনুর রশীদ জানান, কিছুদিন ধরে যমুনায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। ভাঙনরোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করাসহ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, যমুনার ভূঞাপুর অংশে ভাঙনের বিষয়টি ইউএনও’র মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের জন্য একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকায় ইকোনমিক জোনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। ইকোনমিক জোনের কাজ শুরু করা হলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়ে যাবে।
তিনি জানান, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি গ্রামের উত্তর এবং দক্ষিণের মাঝে ১ হাজার ৬২৫ মিটার অংশ অরক্ষিত রয়েছে। ওই স্থানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী শুকনো মৌসুমে বাঁধের কাজ ধরা হবে।