শম্ভুগঞ্জ সেতু
শতকোটি টাকার দরপত্রে ‘সমাঝোতা’ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোজাম্মেল খোকন, ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহে নেগোসিয়েশন ও সমাঝোতার মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত শম্ভুগঞ্জ সেতুর প্রায় শত কোটি টাকার টোল ইজারা প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত করার অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে দরপত্র জমায় বাধা দিয়ে সিডিউল ছিনিয়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে সরকার কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এরই মধ্যে ইজারা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে একটি তুলনামূলক বিবরণী (সি.এস) প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত ময়মনসিংহ সড়ক ভবনের নির্বাহী প্রকৌশলী খাইরুল বাশার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। গতকাল রোববার দুপুরে নিজ দপ্তরে এসব তথ্য জানান খাইরুল বাশার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন।
এর আগে গত ২৭ মে ময়মনসিংহ সড়ক ভবনের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে দরপত্র দাখিলে বাধা ও সিডিউল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গত ২৯ মে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন ভুক্তভোগী মেসার্স সৌরভ ব্রিকসের স্বত্বাধিকারি মো: মাহাবুবুল হক। একই দিনে ঘটনাটি অবহিত করে কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব অভিযোগের তদন্ত করে কোনো ধরনের ব্যস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এই ভুক্তভোগী। এই বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: মাঈন উদ্দিন বলেন, অভিযোগ পেয়ে ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখনো ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়নি, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বিগত ১৪ বছর ধরে শম্ভুগঞ্জ সেতুর ইজারাদার হিসাবে টোল আদায় করছেন মেসার্স মোস্তফা কামাল। তবে এই ইজারার মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাবেক কাউন্সিলর মো: এমদাদ।
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, শম্ভুগঞ্জ সেতুর ইজারা মেয়াদের ৩ বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা টোল আদায় হয়। কিন্তু একটি প্রভাবশালী চক্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে গোপন সমঝোতা করে টানা ১৪ বছর ধরে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কম টাকায় ইজারা নিয়ে আসছে। এ কারণেই সিন্ডিকেটকে খুশি রাখতে চলতি দরপত্র অষ্টম দফা আহ্বান না করেই তড়িগড়ি করে চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ- এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীসহ একাধিক ঠিকাদারের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঠিকাদার জানায়, বর্তমান সরকার সব ধরনের টেন্ডার ইজিপি করলেও কর্তৃপক্ষ এই সেতুর ইজারা ম্যানুয়েলি করেছেন। মূলত সিন্ডিকেটকে সমঝোতা বা নেগোসিয়েশনের সুযোগ দিতেই তারা এই প্রক্রিয়া বহাল রেখেছেন।
সড়ক ভবন সূত্র জানায়, গত বছরের ২১ নভেম্বর প্রথম দফায় এই সেতুর ইজারা দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ মে সর্বশেষ সপ্তম দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে ১৫ জন ঠিকাদার সিডিউল ক্রয় করলেও কেউ শেষ পর্যন্ত সিডিউল জমা দেয়নি। এদের মধ্যে মেসার্স সৌরভ ব্রিকসের স্বাত্বাধিকারি মো: মাহাবুবুল হক ছাড়া সবার সাথেই মেসার্স মোস্তফা কামালের সমঝোতা ও নেগোসিয়েশন হওয়ায় কেউ টেন্ডার ড্রপ করেনি। কিন্তু মাহাবুবুল হকের সাথে সমঝোতা না হওয়ায় তিনি টেন্ডার ড্রপ করতে গেলে তাকে বাধা দেয় সন্ত্রাসীরা।
ঠিকাদার মাহাবুবুল হক বলেন, গত ২৭ মে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সপ্তম দফায় দরপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল। ওই নির্ধারিত সময়ের আধাঘণ্টা আগে পার্টনারদের সাথে নিয়ে আমি নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে দরপত্র জমা করতে যাই। এ সময় নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুপস্থিতিতে ১০ থেকে ১২ অজ্ঞাত সন্ত্রাসী আমাদের টেন্ডার জমায় বাধা দিয়ে দরপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় আমি সড়ক কর্তৃপক্ষ এবং থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি। কিন্তু আমাদের অভিযোগ তদন্ত না করেই রহস্যজনক কারণে কর্তৃপক্ষ ইজারা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে সি.এস প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। অথচ এর আগে বিগত ইজারা অষ্টম আহ্বানে করার নজির রয়েছে।
মাহাবুবুল হক আরো বলেন, এ ঘটনায় গত ১১ জুন মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হলে আমাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন বিজ্ঞ বিচারক। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী আমাদের অভিযোগ তদন্ত না করে আগামী ৩০ জুন চলতি ইজারার মেয়াদ শেষ হবে কারণ দেখিয়ে অভিযোগ বিবেচনা করার আইনগত সুযোগ নেই বলে নিষ্পত্তি করা হলো- মর্মে একটি চিঠি দিয়েছেন। অথচ এর আগে এই ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একাধিকবার সড়ক ভবন থেকে খাস আদায়ের নজির রয়েছে।
টেন্ডারে সমাঝোতা ও নেগোসিয়েশনের সত্যতা স্বীকার করেছেন মেসার্স মোস্তফা কামাল এন্টাপ্রাইজের প্রভাবশালী অংশীদার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক মো: এমদাদ। তিনি বলেন, ঠিকাদারি কাজে সব জায়গাতেই নিকু (নেগোসিয়েশন) হয়, আমরাও করেছি। যাদের বিডি জমা ছিল, তাদের সবার সাথে আমাদের নিকু হয়েছে। এখন কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করতেই পারে। এতে কিছু যায় আসে না। তবে টেন্ডার জমায় কাউকে বাঁধা দেওয়া হয়নি। সড়কের জরিপ রিপোর্টেই ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার টেন্ডার দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সড়ক ভবনের নির্বাহী প্রকৌশলী খাইরুল বাশার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন বলেন, ইজারা প্রক্রিয়ার একটি তুলনামূলক বিবরণী (সি.এস) প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। এখন তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সেমতে ব্যবস্থা গ্রহন করব। আর হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে আর অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছি। তবে টেন্ডার জমায় বাধা দেওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।