বাঁশের মাচায় ঝুলছে রঙ-বেরঙের তরমুজ। হলুদ, সবুজের সঙ্গে রয়েছে বাংলা লিঙ্ক কালারও। প্রতিদিন খেত থেকে তুলে এসব তরমুজ বিক্রির জন্য সড়কের পাশে জড়ো করছেন চাষিরা। পথচারীরা নানা রঙের তরমুজে আকৃষ্ট হয়ে ক্রয়ও করছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে সরাসরি খেত থেকেই তরমুজ নিয়ে যাচ্ছেন। অসময়ে মাঠের পর মাঠজুড়ে তরমুজের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন জয়পুরহাটের চাষিরা। এ এলাকায় তরমুজ চাষে যেমন ঘুঁচেছে বেকারত্ব, সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানেরও। এপ্রিলের প্রথম থেকে তরমুজ বিক্রি শুরু হলেও চলবে ডিসেম্বর পর্যন্ত। জয়পুরহাটের সদর, আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল উপজেলা ছাড়াও পাঁচবিবি উপজেলার ভূতগাড়ি, ভারাহুত, শিরট্টি, গোড়না, জালালপুরসহ আশপাশে অনেক মাঠ থেকে নানা রঙের তরমুজ বেঁচাকেনা হচ্ছে। অন্য ফসলের তুলনায় তরমুজ বিক্রি করে তিনগুণ লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। ফলে দিন দিন বেড়েই চলছে মাচা পদ্ধতিতে তরমুজের চাষ। পাইকারি বাজারে এসব তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। সদরে ৩ হেক্টর, পাঁচবিবিতে ১৫ হেক্টর, আক্কেলপুরে ৭ হেক্টর, ক্ষেতলালে ৫ হেক্টর ও কালাই উপজেলায় ৫ হেক্টর জমিতে বাঁশের মাচায় তরমুজ চাষ হয়েছে।
চাষিরা জানান, বছরের নয় মাস বাঁশের মাচায় তরমুজ চাষ করা যায়। চারা রোপণের ৫০ দিনের মধ্যে ফলন আসে এবং পরিপক্ক ফল হয়। লাভজনক হওয়ায় বেড়েছে তাদের আগ্রহ। দাম ভালো পাওয়ায় তারা খুশি। তরমুজ চাষকে কেন্দ্র করে ভূতগাড়ী এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেক দোকানপাটও। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরমুজ চাষের গল্প বেশি দিনের নয়। ২০১৮ সালে পাঁচবিবি উপজেলার ভারাহুত গ্রামের কৃষক আবু মুসা তার আড়াই শতক জমিতে বাঁশের মাচায় তরমুজের চাষ শুরু করেন। পল্লী কর্মণ্ডসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর আর্থিক সহায়তায় রুরাল ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (জেআরডিএম) এর কারিগরি সহযোগিতায় বাঁশের মাচা বাবদ ওই জমিতে তার খরচ পড়ে ৫ হাজার টাকা। ওই বছর তিনি উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি করেছিলেন ২৬ হাজার টাকা। তার দেখাদেখি অন্যরাও ঝুঁকে পড়েন তরমুজ চাষে। সেই থেকে কৃষকদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তরমুজ চাষে এ এলাকার চাষিদের ঘটেছে আর্থিক পরিবর্তন। যাদের আগে কিছুই ছিল না, তরমুজ চাষ করে তারা এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। ভারাহুত গ্রামের চাষি আবু মুসা বলেন, এবার সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলন ভালো হলে বিঘায় ৮০ থেকে ১০০ মণের ওপর তরমুজ উৎপাদন হবে। দাম ভালো থাকলে বিক্রি হয় এক থেকে সোয়া লাখ টাকা। এবার ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ পর্যন্ত তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। তরমুজ চাষে এই এলাকার মানুষ দিনদিন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মুসার পরামর্শে গত কয়েক বছর ধরে তরমুজ চাষ করছেন চাষি রেজুয়ান মণ্ডল। এবার তিনি দুই বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। রেজুয়ান মণ্ডল বলেন, হলুদ ও সবুজ জাতের তরমুজ চাষ করেছি। বছরের ৯ মাস তরমুজের চাষ করা যায়। শীত মৌসুম আসলে এসব জমিতে আলু চাষ করা হয়। ধান-আলু এলাকার প্রধান ফসল হলে কি হবে? তরমুজ চাষেই অধিক লাভ হয়, আয়ও হয় অনেক। তাই তরমুজ চাষ দিন দিন বেড়েই চলছে। আরেক চাষি আব্দুল করিম বলেন, জমিতে ধান-আলুর চাষ করলে বছরে তিনবার বিক্রি করা যায়। আর এই জমিতে তরমুজ চাষ করলে বছরের নয় মাস বিক্রি করে টাকা পাওয়া যায়। তখন অভাব কি তা বোঝা যায় না। তরমুজ চাষ আমাদের সবকিছুই পরিবর্তন করে দিয়েছে। আগামীতে এর চাষ আরও বাড়বে। চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা পাইকার জসিম উদ্দিন বলেন, বাজারে তরমুজের চাহিদা ব্যাপক। বছরের নয় মাস এ এলাকায় তরমুজের চাষ হয়, তা আমি আগে থেকেই জানি। গত চার বছর ধরে এখানকার তরমুজ আমি নিয়ে যাই। গড়ে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা মণ (৪০ কেজি) দরে তরমুজ কিনেছি। এলাকায় নিয়ে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করি। এখানকার তরমুজ অনেক রসালো এবং মিষ্টি হওয়ায় বাজারে চাহিদাও বেশি। কালাই বাজারে তরমুজ বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে জমি থেকে তরমুজ পাইকারি দামে নিয়ে এই বাজারে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। সারা দিনে লাভ ভালোই টিকে। অন্য এলাকার চেয়ে এ এলাকার তরমুজগুলোর চাহিদা বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ রাহেলা পারভিন বলেন, মালচিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন এই তরমুজ চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন রঙের ফাঁদ, সেক্স ফেরোমন ট্যাব ও জৈব বালাইনাশক। এতে করে একদিকে ফসল হচ্ছে নিরাপদ অন্যদিকে কমছে উৎপাদন খরচ আর কৃষক হচ্ছে আর্থিকভাবে লাভবান। কৃষি বিভাগ থেকে চাষিদের সবসময় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এবার ফলন ও দাম পাওয়ায় আগামীতে তরমুজের চাষ আরো বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী।