খরায় দেশি ফল চড়া
* শুল্ক বাড়ায় কমল বিদেশি ফল আমদানি * দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম
বাজারে বিদেশি ফলের দাম বেশি থাকায় দেশীয় ফলের দিকে নজর রাখেন নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ। তবে এবার দেশীয় ফলের দাম কমেনি, বাড়তি দামে ফল কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষ। মৌসুমি ফল লিচুর কেজি হাজার ছাড়িয়েছে, আমের কেজিও শতকের নিচে নামেনি। কাঁঠালের দামেও বেশ চড়া।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, উত্তরা ও শনিরআখড়াসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি সব ফলের দাম বাড়তি। বাজারে এক কেজি আমের দাম হাঁকানো হচ্ছে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা। মানভেদে অবশ্য তা মিলছে দুইশ’ টাকায়ও। এর মধ্যেই লিচুর দাম বেড়ে ১৫শ’ টাকা হয়েছে। ডালিমের কেজি ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমি ফলের এই দামের ঊর্ধ্বগতির দৌড়ে পিছিয়ে নেই আনারস। মানভেদে প্রতি পিস আনারস ৫০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব দেশি ফলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলার দাম ডজনে বেড়ে গেছে ৪০ টাকা। দেশির পাশাপাশি বাড়তি দরের তালিকায় আছে সব ধরনের আমদানি করা ফলও। কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে মালটার দাম ঠেকেছে ৩শ’ টাকায়। এক কেজি আঙুর ও আপেল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। ছোট-বড় আকার অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে আনার। দেশি ফলের উচ্চমূল্যের জন্য দায়ী করা হচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহকে। অন্যদিকে বিদেশি ফলের জন্য দায়ী করা হচ্ছে ডলারের বাড়তি দাম ও শুল্কহারকে।
দেশে ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর বাদামতলী বাজার। কাকডাকা ভোরে এই বাজারে শুরু হয় বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রলার ও ট্রাকে করে ফল আসে বাদামতলী ঘাটে। দেশীয় ফলের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলও বিক্রি হয় বাদমতলী বাজারে। রাজধানীর আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা ফল কিনতে আসেন এ বাজারে। ফল কিনতে কারওয়ান বাজারে কাভার্ড ভ্যানের সামনে ভিড় দেখা গেলেও ভিন্ন রকম বাদামতলী বাজার। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ট্রলারে করে ফল আমদানি করা হয়। মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, দেশে এখন গরিবের জন্য কোনো ফল নেই। সব ফল বাড়তি দামে কিনে খুচরা বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারে আম ও লিচুর আমদানি কমে গেছে। সেজন্য এবার ভালো মানের আমের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামেনি। মিরপুর দশ নম্বর এলাকার বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কম দামে আম ও লিচু কিনতে মিরপুর এক নম্বর মাজার গেটের সামনে রাস্তার উপরে বসা খোলাবাজারে এসেছিলেন। কিন্তু ফলের দাম চড়া হওয়ায় অল্প করে কিনেন। মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যের সঙ্গে ফলের দামও প্রত্যেক দিন বাড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ফলের মৌসুমে দাম কমে আর বাংলাদেশে বাড়ে। আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীরা অসহায় হয়ে পড়েছি। কারণ বর্তমান বাজারদর আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মিরপুর ফলের দোকানের বিক্রেতারা বলেন, মোকামে দাম যেহারে বাড়ছে, তাতে ব্যবসা করা দায় হয়ে পড়েছে। আমরা খুচরা বিক্রেতা। মোকামে দাম বাড়লে আমাদের কাছেও বাড়ে। সবখানেই সিন্ডিকেট রয়েছে বলে তারা জানান। এবার গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে আম ও লিচু ঝড়ে পড়েছে। সেজন্য মৌসুমি ফলের জন্য সবচেয়ে শুভ সময় মে-জুনেও রসালো ফল আম, কাঁঠাল ও লিচু বাজারে পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় ফল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। প্রতিবছর গরমকালে দেশীয় ফল ক্ষতির মুখে পড়ে। অথচ এ মৌসুম নিয়ে কৃষি বিভাগের পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ঝড়-বন্যার মতো তাপপ্রবাহকে সেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবেও দেখা হয় না। ফলে ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত ফলের সরবরাহ নেই।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় অতিরিক্ত তাপ ক্ষতি করে আমের ফলনের। খরায় কুঁকড়ে যায় পাতা, ঝরে পড়ে আমের গুটি। এবার অন্তত ২০ শতাংশ গুটি ঝরে যায়। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, খরা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আম ও লিচুর গুটি ঝরে পড়ে। সেজন্য বাজারে আম ও লিচুর দাম বেশি হয়েছে।
ঢাকা মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ফরিদুল হক প্রত্যেক বছরের মতো এবারও রাজশাহীতে আমের বাগান কিনেছিলেন। তিনি বলেন, এবার প্রচণ্ড রোদে আমের বোঁটার রস শুকিয়ে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে। মৌসুমের শুরুর দিকে বেশ ভালো মুকুল এলেও গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। বৃষ্টি না হওয়ায় আমের আকার ছোট হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন কমেছে।
দেশি ফলের সঙ্গে বিদেশি ফলের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে সাউথ আফ্রিকার গালা আপেলের কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি। চিনা ফুজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৮০ কেজি, যা ছিল ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। কমলা মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা, যা ছিল ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। বেড়েছে ৫০ টাকা। নাশপাতি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি। বেড়েছে ৪০ টাকার বেশি। মানভেদে সাদা আঙুর বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি, যা ছিল ২১০-২২০ টাকার মধ্যে। বেড়েছে ৬০ টাকা। মানভেদে কালো আঙুরের দাম ছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ছোট ও মাঝারি আনার কেজিতে প্রায় ৮০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা।
ফল ব্যবসায়ী সুজন মণ্ডল বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানি করা বিদেশি ফলের ওপর শুল্কহার বাড়িয়েছে। ফলের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। বিশেষ করে আগে প্রতিকেজি আপেল, কমলা ও মাল্টায় ৬২ টাকা শুল্ক নিতো। এখন শুল্ক আদায় করছে ৮৮ টাকা। একইভাবে ৯৮ টাকার আঙুরে শুল্কহার ১১৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, তা এখন বেড়ে ২৩ শতাংশ হয়েছে।
এছাড়া দেশি ফল আনারস ৮০ টাকা, বড় বেল ২০০ থেকে ২২০ টাকা, প্রতি পিস জাম্বুরা ২০০ টাকা। স্ট্রবেরি কেজি ৪০০ টাকা, প্যাকেট করা স্ট্রবেরি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। পাকা পেঁপে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, পেয়ারা ৯০ টাকা, তরমুজ ৮০ টাকা, সফেদা ১৫০ টাকা, কৃষি বিভাগ বলছে, খরা ও তীব্র তাপপ্রবাহে ঈশ্বরদীতে লিচুর ফলন ও উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জানান, এ বছর ঈশ্বরদীতে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়। তবে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে লিচুর গুটি ঝরে পড়ে, এতে ভালো ফলন হয়নি। সেজন্য বাজারে চড়া দামে লিচু বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। বাদামতলী ফলের আড়তদার হাজী আফছার করিম সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. শাওন বলেন, প্রতিদিন ফলের দাম বাড়ছে। মালটা, নাশপাতি, কমলা, আপেল, আনার ও আঙুর আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। যা ডলারের দামের সঙ্গে ওঠানামা করে। কিন্তু হঠাৎ করে ফল আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর ডলার সংকট। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে চায় না ব্যাংকগুলো। সেই সঙ্গে আছে অন্যান্য ভ্যাট ও কর। এতে বিদেশি ফল আমদানি অনেকটা কমেছে। বিদেশি ফলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার ফল আমদানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেছে। এতে ফল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছি। শুল্ক না কমলে এসব ফলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। শুল্ক কমলে বিদেশি ফলের দাম কমবে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঝড়, বন্যার মতো তাপপ্রবাহকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। তাপপ্রবাহকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ নিতে কৃষকরা ঘূর্ণিঝড়-বন্যাকে যেভাবে নেয়, তাপপ্রবাহকে সেভাবে নেয় না। এ বিষয়ে সার্বিকভাবে সবার সচেতনতার অভাব আছে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে ফসল পরিচর্যার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।