ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজারের চিকিৎসাসেবা নিয়ে উদ্বেগ কেটেছে

* বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকছে ডিসেম্বর পর্যন্ত * সরকারি চিকিৎসাসেবায় এনজিওর উপর নির্ভরশীল নিয়ে প্রশ্ন
কক্সবাজারের চিকিৎসাসেবা নিয়ে উদ্বেগ কেটেছে

কক্সবাজার জেলাবাসীর সরকারি চিকিৎসাসেবা সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আপাততে কেটেছে। রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয়দের জন্য বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দ অর্থে স্বাস্থ্য বিভাগে এনজিও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকছে আরো ৬ মাস। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় গত রোববার শেষ হয়েছিল এনজিও অধিনে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্প। এনিয়ে জেলাব্যাপী চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয়ের শংকা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১ জুলাই গতকাল সোমবার সকালে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে মেইলে প্রেরিত একপত্রে এসব প্রকল্প আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক রাখার নিদের্শ প্রদান করা হয়েছে। কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের ‘স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রকল্প (এইচজিএফপি), স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্প (এইচজিএস) অধিনে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন এনজিও সংস্থা জেলাব্যাপী হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জনবল নিয়োগসহ নানা সহায়তা করে আসছে। ২০১৯ সালে শুধু হওয়া এসব প্রকল্প ৩০ জুন অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জনবল প্রত্যাহারের চিঠি প্রদান করেছিল। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহ সরকারের নানা পর্যায়ে চিঠি প্রেরণ করে জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার (১ জুলাই) বিশ্বব্যাংকের পক্ষে প্রেরিত এক চিঠি এসব প্রকল্প আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আগামী ৬ মাসও স্ব-স্ব আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওগুলো এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এরপর বিশ্বব্যাংকের অধীনে এসব প্রকল্প আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএসও বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, জুনায়ারি ২০২৫ সাল থেকে আইএসও জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের এসব প্রকল্পের দায়িত্ব পাবেন এবং এটি ধারাবাহিক থাকবে। ফলে কক্সবাজার জেলাবাসীর চিকিৎসা সেবা নিয়ে তৈরি হওয়া শংকা কেটে গেছে বলে জানান তিনি। কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারিভাবে নিয়োগ করা জনবল ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অধীনে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সেন্টমার্টিন হাসপাতাল, জেলার ৭২ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এই সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের ১৯৯ জন, উখিয়া হাসপাতালের ৯২ জন, টেকনাফ হাসপাতালের ৮০জন, সেন্টমার্টিন হাসপাতালের ১৬ জন, পেকুয়া হাসপাতালে ৫২ জন, চকরিয়া হাসপাতালে ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালনের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া ৭২টি ইউনিয়ন হাসপাতালে ৩ শতাধিক কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পদায়ন করা চিকিৎসকসহ ১৯৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারী না থাকলে হাসপাতালটি ভর্তি রোগী, বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করছিলেন স্বয়ং হাসপাতালটি চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। শুধু তা নয়, এই বিশাল জনবল শূন্যতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত আইসিইউ, সিসিইউসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিভাগই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আশেকুর রহমান।

তিনি জানান, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছেন। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক বা জনবল দ্বারা চিকিৎসা প্রদান কঠিন ছিল। প্রকল্প থাকায় স্বস্তি পাচ্ছি। এতে ২০২২ সালে সরকার ঘোষিত সারা দেশের মডেল হাসাপাতাল কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করেন ডা. আশেকুর রহমান। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু তাহের জানান, বিশ্বব্যাংকে অর্থায়নে নিয়োগকৃত জনবল দিয়েই হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা, ওষুধ প্রদান, রোগীর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিবিড় শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, আইসিইউ, সিসিইউ ও ২৪ ঘণ্টা প্যাথোলজি ব্যবস্থা ছিল। আর এসব কারণে এটি মডেল হাসপাতাল। এপ্রকল্প ৬ মাস বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা স্বস্তি। এটা যেন ধারাবাহিকতা রাখা হয়।

সরকারি চিকিৎসাসেবায় এনজিওর উপর নির্ভরশীল নিয়ে প্রশ্ন

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওর অধীনে কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য বিভাগে চিকিৎসকসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ এবং এসব জনবল না থাকলে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রাখা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। যা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেয়া সর্বশেষ ১ জুনের তথ্য বলছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয়ের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬টি সংস্থার অধীনে ১৯৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদায়ন রয়েছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। যেখানে আইসিইউ ও সিসিইউ পরিচালনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মোট ৪৬ জনচিকিৎসক রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন নার্স ও মিডওয়াইফ ১৩ জন, বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ান ১ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস ৫ জন, ল্যাবোটরি টেকনোলজিস ২ জন, রিডওলজি টেকনোলজিস ২ জন, লাইফ অপারেটর ১ জন, অ্যাম্বুলেন্স চালক ১ জন, বৈদ্যুতিক কারিগারি ১ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৩৮ জন, ওয়ার্ড মাস্টার ১ জন, আনসার সদস্য ১৫ জন, নিরাপত্তা কর্মী ৭ জন, ওয়ার্ড বয়-আয়া ২০ জন, অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) সহযোগী ৬ জন, সিনিয়র ফার্মাসিস্ট ১ জন, ল্যাব সহকারী ২ জন, স্টোরকিপার ১ জন, ডাটা অপারেটর ১ জন, আইএমসআই বিশেষজ্ঞ ২ জন, ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞ ৪ জন, সমন্বয়কারী ১ জন, চক্ষুবিশেষজ্ঞ ১ জন, টিকিট বিভাগে ৫ জন, ম্যানুয়ার ওয়ার্কার ১০ জন, কেস ওয়ার্কার ২ জন, ইডি সহযোগী ৮ জন, স্যানিটারি কর্মী ১ জন। এর বিপরীতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সরকারি মঞ্জুরিকৃত ৩২৮টি পদের মধ্যে ৭৬টি শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ৬৮টি চিকিৎসকের পদে কর্মরত রয়েছেন ৫২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সের ১৮০টি পদে কর্মরত রয়েছেন ১৫৭ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৩৬ পদে ৩১ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ৪৪ পদে ১২ জন কর্মরত রয়েছেন। আর এনজিও এই জনবল না থাকলে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের হাসপাতালটি ভর্তি রোগী, বহিঃ বিভাগ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করছেন স্বয়ং হাসপাতালটি চিকিৎসকরা। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আশেকুর রহমান জানান, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছেন। কিন্তু সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক বা জনবল দ্বারা চিকিৎসা প্রদান কঠিন এবং হিমশিম খেতে হবে। জরুরি বিভাগে বর্তমানে ১৫ জন চিকিৎসকের পরিবর্তে তা ২ জনকে সামলাতে হবে। এটা সম্ভব না। তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত সারা দেশের মডেল হাসপাতাল হওয়ার ক্ষেত্রে যে ৮টি কারণ রয়েছে তাতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই দেশের অন্যান্য জেলা হাসপাতালের চেয়ে বেশি সেবা প্রদান, বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের চেয়ে বেশি রোগীর সেবা প্রদান এবং এ হাসপাতালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হয়েছে। এটা সম্ভব ছিল অতিরিক্ত জনবলের কারণে। এই জনবল না থাকলে তার উল্টোটা হবে। চিকিৎসাসেবা বিপর্যয়ের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তৈরি হবে জটিলতা। এমন কি মাত্র কয়েক সপ্তাহে নোংরা পরিবেশই বিরাজ করতে পারে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু তাহের জানান, বিশ্বব্যাংকে অর্থায়নে নিয়োগকৃত জনবল দিয়েই হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা, ওষুধ প্রদান, রোগীর জন্য পরীক্ষা- নিরীক্ষা, নিবিড় শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, আইসিইউ, সিসিইউ ও ২৪ ঘণ্টা প্যাথোলজি ব্যবস্থা ছিল। আর এসব কারণে এটি মডেল হাসপাতাল। জনবল না থাকলে তা রক্ষা করা যাবে না। জেলা সদর হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ, সিসিইউ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু জেলা সদর হাসপাতালের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে এনজিওর উপর নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সামাজিক সংগঠন ‘মুক্তকেন্দ্র কক্সবাজার’ এর সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট রিদুয়ান আলী জানান, সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ বা চিকিৎসাসেবা কেন এনজিওর প্রকল্পের উপর নির্ভর করবে। শতভাগ সরকারি জনবল নিয়োগ, অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এদেশের নাগরিকরা সরকারিসেবা গ্রহণ করবেন। তবে কোনো রোহিঙ্গা যেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না দেন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা করতে হবে রোহিঙ্গাদের জন্য। সরকারি চিকিৎসাসেবা শতভাগ সরকারের অধীনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বরাদ্দ অর্থের ২৫ শতাংশ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর। এই অর্থ সরাসরি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের জমা হবে। সরকারই বাস্তবায়ন করবে জনবল নিয়োগসহ সব কার্যক্রম। এখানে আন্তর্জাতিক বা দেশীয় এনজিওর অধীনে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। এতে এনজিওর উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। এটা শুভকর না। কক্সবাজার জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো জানান, সব সময় এনজিওর উপর নির্ভরশীলতা থাকছে না। এটা কেটে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অধীনে আইএসও চুক্তি হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে এই চুক্তি। এটা হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা আইএসও’র মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর সরাসরি জনবল নিয়োগসহ স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি দেখবেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত