শ্রীনগরে ড্রেজারের আধিপত্য

শত শত বিঘা ফসলি জমি বিলুপ্তির পথে

প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি

সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে দুই ও ত্রি-ফসলি জমি ভরাটের ফলে কৃষিজমি বিলুপ্তির পথে। ড্রেজার দিয়ে কৃষিজমি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে। এতে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ভারমান্য নষ্ট হচ্ছে। আইন ভঙ্গ করে ড্রেজারের তাণ্ডবে প্রতি বছর শত শত বিঘা ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন না করায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। নির্বিচারে কৃষিজমি ভরাটের কারণে অনেক জায়গায় বর্ষা সেচের পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে জলাবদ্ধতা। কিন্তু এই আইনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে ফসলি জমি ভরাট করা হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রামে ফসলি জমিতে বাঁধ, ড্রেজার দিয়ে মাটি ভরাট করে বসতভিটা নির্মাণ করা হচ্ছে। বছরের পর বছর এই অবস্থা চললেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সরকারি ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা। উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে প্রতি বছর সড়কের ধারে আবাদি কৃষিজমি ভরাট হচ্ছে। এসব জমি ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতঘর, রাস্তাঘাট, দালানকোঠা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ফসলের পরিবর্তে যেখানে শোভা পাচ্ছে পাকা দালানকোঠা। অব্যাহতভাবে ভরাট হওয়ায় উপজেলায় হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমি আর এতে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। অথচ কৃষিজমি অক্ষত রেখে উন্নয়নের জন্য বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে দুই ও ত্রি-ফসলি জমি সংরক্ষণে তার জোড়ালো নির্দেশনা ছিল। কৃষিজমি সুরক্ষায় নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিয়েছেন তিনি। বালুদস্যু ও ভরাট সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফসলি কৃষিজমিগুলো ভেকু মেশিন দিয়ে গভীরভাবে কেটে পকেট তৈরি করে রাখছে। কেউ কেউ পকেট কাটার সাথে সাথে ড্রেজারের পাইপ বসিয়ে ভরাট কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। এ ভরাটের জোগান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাঘড়া-ভাগ্যকুলের মাঝা মাঝি পদ্মা নদীর চড়ে অর্ধশতাধিক কাটিং ড্রেজার ও কৃষিজমি। অর্থাৎ এক জমি ভেকু দিয়ে কেটে পকেট করে। অন্য জমি থেকে কাটিং ড্রেজারের মাধ্যমে পাইপ লাইন দিয়ে মাটি কেটে এনে পকেট ভরাট করা হচ্ছে। এসব কাজ কারবার স্থানীয় ভূমি অফিসগুলোর নাকের ডগায় ঘটলেও যেন দেখার কেউ নেই। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বীরদর্পে ভাগ্যকুল, মান্দ্রা-বালাসুর বাগান বাড়ি হয়ে ঢাকা-দোহার রোড বোরিং করে আঁড়িয়াল বিলে কৃষিজমি বালু ভরাট করছে বালাসুর বৌবাজারের জাহাঙ্গীর মৃধা গং, বর্ষা তথা ড্রেজার মৌসুমকে সামনে রেখে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নেই তৎপর হয়ে উঠেছে বালুদস্যু ও ভরাট সিন্ডিকেটের সদস্য কামারগাও ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন, সাবেক মেম্বার ছামাদ, উত্তর বালাশুরের, রাঢ়ীখালের রোকন, তুহেল, ষোলঘরের লালচান, মোবারক, কবুতরখোলার, মাসুদ, মাতিন, জশলদিয়ার আশরাফ চেয়ারম্যান, শামীম, কুকুটিয়ার আজিম মেম্বার, ফিরোজ, শামীম, আবুল বেপারী, হাশেম আলী আমিন, পশ্চিম নওপাড়ার আলমগীর, আমির হোসেন, তন্তরের শাহিন, বাড়ৈগাওয়ের খলিল, নাগেরহাটের মিজান, আলমপুরের লাভলু মোড়ল, মোসলেম, শাহিন, আহসান, মদনখালীর রাসেল, আশা, হিরো, বাড়ৈখালীর সাঈদ, বাঘড়ার আনু মেম্বার, আরধীপাড়ার টিটুসহ আরো অনেকেই।

এরই মধ্যে তারা শত শত বিঘা কৃষিজমি ভেকু দিয়ে কেটে পকেট তৈরি করে রেখেছে। প্রতিবারের মতো এবারও খালবিলে পানি আসার সাথে সাথেই বালুবাহী ভলগেট এনে ভাসমান ড্রেজারের মাধ্যমে ভরাট হবে ওই সব পকেট। এসব ভূমি খেকো সিন্ডিকেটরা শুধু পকেট তৈরি আর ভরাট করেই ক্ষ্যান্ত নয়, বরং তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ পার্শ¦বর্তী জমির কৃষকরা। এব্যাপারে ভুক্তভোগী স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকে জানা যায়, একটি জমিতে পকেট কাটলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় চার পাশের অন্যান্য জমির মালিকরা। কারণ, পকেট তৈরির সময় সীমানা লঙ্ঘন করে খেতের আইলসহ জমির ওপর মাটি ফেলে পাড় বেঁধে নেয় তারা। প্রতিবাদ করলে উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয় তাদের। তাই অনেক কৃষক তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। সাম্প্রতিককালে তৈরি করা যেসব পকেট বর্তমানে কাটিং ড্রেজারের মাধ্যমে ভরাট করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কতিপয় ব্যক্তি বলেন, সব কিছু ম্যানেজ করে সরকারি-বেসরকারি জলাশয় ও কৃষিজমি ভরাট করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা মনে করছেন, সরকারের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যদি কৃষিজমি ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারে তাহলে (১০-১৫) বছরের মধ্যে এই অঞ্চলের কৃষিজমি একেবারেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে। কৃষিজমিতে বাড়ি নির্মাণে ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলে কেউ মানছেন না। নিজেদের ইচ্ছা মতো কৃষিজমিতে বাঁধ দিয়ে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে বলে দাবি রাঢ়ীখাল ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক খান বারী। তিনি বলেন, ড্রেজার দিয়ে কৃষিজমি ভরাট দ্রুত বন্ধ না করলে অল্প সময়ের ব্যবধানে আমাদের এই অঞ্চলের কৃষিজমিগুলো আর টিকানো সম্ভব হবে না। এব্যাপারে অবৈধ ড্রেজার সিন্ডিকেট চক্রের অন্যতম সদস্য মো: জাহাঙ্গীর গং-এর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রশাসনসহ সবাইকে মেনেজ করেই এই ব্যবসা করি। এই বিষয়ে রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের ভূমি অফিসার আমির হোসেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভেঙে দিয়ে আসার পর আবার অদৃশ্য শক্তির কারণে এরা কাজ করে কীভাবে আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মোশারেফ হোসাইন বলেন, এসিল্যান্ড ছুটিতে রয়েছে। আমি একা। ইউনিয়ন তহসিলদারদের বলে দিয়েছি তারা ব্যবস্থা নেবে।