তীব্র আকার ধারণ করেছে গ্যাস সংকট। দিনের বেশিরভাগ সময় চুলা জ্বলছে না বাসাবাড়িতে। রাত ১২টার পর পাইপলাইনে আসলেও ভোর ৫টার মধ্যেই চলে যায়। দিনের বেলা গ্যাস থাকলেও চুলা নিবু নিবু করে। যার ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই রাতে রান্না করেন। অনেক সময় চুলা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্যাস সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মানিকনগন, শনির আখড়া, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, নদ্দা ও কুড়িল বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লাইনের গ্যাস বেশিরভাগ সময়ই থাকে না। গ্যাসের চাপও থাকে কম। এর ফলে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে অনেক পরিবার। আবার কোনো উপায় না পেয়ে অনেক সময় হোটেল থেকে খাবার এনে খাচ্ছেন অনেকে।
গ্যাস সংকট নিয়ে কথা হলে যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ফজলু মিয়া বলেন, ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চুলাই জ্বলে না। মাঝে মধ্যে রাইস কুকারে রান্না করতে হচ্ছে। প্রায়ই হোটেল থেকে ভাত-তরকারি কিনে খেতে হয়। এভাবে সব সময় চলা সম্ভব না। ফজলু মিয়ার মেয়ে লামিয়া জানান, রাত জেগে রান্না করার ফলে দৈনন্দিন জীবনের রুটিন পাল্টে গেছে আমাদের। রান্নার কাজ শেষ করে ঘুমাতে হয় ভোরের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে কীভাবে কি করব বুঝতে পারছি না। শনির আখড়ার বাসিন্দা সুরভী আক্তার বলেন, অনেক দিন ধরে এ এলাকায় গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। রাত ১২টায় এসে ভোরে আবার চলে যায়। দিনের বেলা গ্যাস পাওয়া যায় না।
কদমতলী এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই দিন আগে ঘোষণা ছাড়াই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে গ্যাস বন্ধের বিষয় জানিয়ে দিতো তিতাস। কিন্তু এখন ঘোষণা ছাড়াই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে কঠিন বিপাকে পড়তে হয় আমাদের।
জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরে দিনে দু-তিন ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। মগবাজার ওয়্যারলেস, রমনা, সিদ্ধেশরী, বেইলি রোড এলাকার চিত্র একই। রাতে আসলেও দিনে গ্যাস থাকে না।
এদিকে গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। কলকারখানা মালিকরা সরকারের একাধিক দপ্তরে চিঠি দিলেও প্রতিকার মিলছে না। গ্যাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান রুগণ হয়ে পড়লে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে বলেও চিঠিতে সতর্ক করা হয়।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সামিট গ্রুপের এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় একটি টার্মিনাল দিয়ে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ কূপ থেকে আরো ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের। ফলে বর্তমানে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে।
এদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, সব এলাকায় সমস্যা নেই। কিছু কিছু এলাকায় আছে। সাপ্লাই কম থাকায় এমন হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ে ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রেগাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন সরবরাহ কম।
তবে চলতি মাসের মাঝামাঝি চলমান সংকট কেটে যাবে বলে দাবি করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এমনিতেই দীর্ঘদিন গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্প খাত। এ সংকট থেকেই সরকার গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু হয়।
জানা যায়, তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কয়েক মাস ধরে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ ফেব্রিক প্রসেসিং ব্যয়ও বেড়েছে, যা এ খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে লেখা এক চিঠিতে একথা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
দাম বাড়লেও বাড়েনি সরবরাহ : গত বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক মিটার ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা ধার্য অর্থাৎ ৯৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে আশ্বস্ত করা হয়, এরপর থেকে শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বিগত এক বছরের বেশি সময় মিলগুলো বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফ দিলেও গ্যাসের সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। ফলে মিলগুলোর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানি আদেশ পরিপালন করতে পারছে না।
সম্প্রতি এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ গণমাধ্যমে বলেন, এই লাইন তিতাস দেয় না বা কিছু করে না। এগুলো দেশের বিষয়, দেশে ইন্ডাস্ট্রিলাইজেশন করার স্বার্থে বোর্ড মিটিংয়ে ডিসিশন হয়। এটি ইচ্ছা করে কেউ কাউকে দেয় না। তিনি বলেন, আমরা তো গ্যাস আনি না, গ্যাস আনে পেট্রোবাংলা। আমাদের কাজ হলো ডিস্ট্রিবিউশন করা। একটি এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৫০০ মিলিয়ন ফুট গ্যাস কাট হয়েছে।
এজন্য সাফার করতে হচ্ছে। এটি এই মাসের মাঝামাঝি চলে এলে সংকট কেটে যাবে।