গাজায় হামাস ও হিজবুল্লাহর বৈঠক
যুদ্ধবিরতিতে রাজি হামাস
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিশ্বায়নের যুগে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে নির্বিচারে ফিলিস্তিনির গাজায় নিরীহ মানুষ হত্যার মহোৎসব চলছে। আর এই হত্যাযঞ্জের পেছনে ইসরাইলি বাহিনীকে সহযোগিতা করছে পশ্চিমা বিশ্বের কিছু মোড়ল রাষ্ট্র। এতে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে ৯ মাসে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ডটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৮ হাজার হয়েছে। আগ্রাসনে আহত হয়েছেন ৮৭ হাজার ৪৪৫ জন ফিলিস্তিনি। তবে ইসরাইলের আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই পেতে গাজায় যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে নিজেদের মিত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করেছে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাস। গত শুক্রবার লেবাননের কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে বৈঠক হয়।
হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং হামাসের রাজনৈতিক শাখার জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল হায়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত নিজেদের প্রস্তাব হামাস উপস্থাপন করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, লেবাননভিত্তিক শিয়াপন্থি সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কেন্দ্রীয় কমান্ড।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিভিন্ন পয়েন্ট নিয়ে মতবিনিময় করেছেন উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদল। ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তি সংলাপ এবং গাজার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে তাদের মধ্যে। গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মত হলে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে জিম্মি করে রাখা ইসরায়েলি সেনা ও পুরুষদের মুক্তি দেয়া হবে বলে হামাসের এক শীর্ষ নেতা গতকাল শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন। খবর রয়টার্স ও জেরুজালেম পোস্টের।
রয়টার্সয়ের প্রতিবেদনে জানা যায়, মার্কিন প্রস্তাব অনুসারে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আগে ইসরায়েলি জিম্মি, আটককৃত সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মুক্ত করার বিষয়ে শিগগির আলোচনা শুরু হবে। এরই মধ্যে ইসরায়েলি আলোচক দল কাতারের রাজধানী দোহায় পৌঁছে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। ১৬ দিন পর এই যুদ্ধবিরতি আলোচনা আবারো শুরু হতে যাচ্ছে। গত ১ জুন গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একটি তিন স্তরবিশিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন জো বাইডেন। তার প্রস্তাব অনুসারে, প্রথম স্তরে গাজায় ৬ সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হবে। এই পর্বে রাফাসহ গাজার অন্যান্য জনবহুল এলাকাগুলো থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে এবং ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি কয়েকশ’ ফিলিস্তিনির মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের কব্জায় থাকা কয়েকজন জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এই দফায় যেসব জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে, তাদের মধ্যে বয়স্ক এবং নারীরা প্রাধান্য পাবেন। এ ছয় সপ্তাহের প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করবে অন্তত ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক। হামাস এবং ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা ও প্রতিরক্ষাবাহিনী এই পর্যায়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাবে। যদি এই আলোচনা ৬ সপ্তাহ সময়সীমার মধ্যে শেষ না হয়, তাহলে পরিকল্পনার প্রথম পর্ব বা যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আরো বাড়বে। এই পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্বে নিজেদের কব্জায় থাকা জিম্মিদের সবাইকে মুক্তি দেবে হামাস এবং তার বিনিময়ে গাজার বাসিন্দারা পাবে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। পরিকল্পনার তৃতীয় পর্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ভবন-রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হবে। হামাসের সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবের প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার ১৬ দিন পর থেকে নিজেদের কব্জায় থাকা সব ইসরায়েলি সেনা ও পুরুষ জিম্মিদের মুক্তি দেয়া শুরু করবে গোষ্ঠীটি। এই যুদ্ধের শুরু থেকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর এবং কাতার। গত মার্চ মাসে কাতারের মাধ্যমে ইসরায়েলের সরকারের কাছে গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চেয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল হামাস। তবে তখন এই প্রস্তাবকে ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। তবে সম্প্রতি তিনি এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা শুরু করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে নেতানিয়াহুর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে তিনি বলেছেন, শান্তি সংলাপ ফের শুরু করতে কাতারে শিগগিরই প্রতিনিধিদল পাঠাবেন তিনি। গত ৭ আগস্ট সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিককে হত্যা করে হামাস যোদ্ধারা। পাশাপাশি জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় ২৪২ জনকে। অতর্কিত সেই হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের উদ্ধারে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। সেই অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এই ফিলিস্তিনিদের ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। এদিকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর এক মাস পর থেকে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ছোড়া শুরু করে হিজবুল্লাহ। পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ)। দিন যত গড়াচ্ছে, ততই তীব্র হয়ে উঠছে উভয়পক্ষের হামলা-পাল্টা হামলা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপির বলছে, হিজবুল্লাহ ও আইডিএফের পাল্টাপাল্টি এই হামলায় গত ৭ মাসে লেবাননে নিহত হয়েছেন ৪৮১ জন। তাদের মধ্যে বেসামরিকদের সংখ্যা ৯৪ জন। অন্যদিকে ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন সেনা এবং ১১ জন বেসামরিক। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাংগঠনিক উপপ্রধান শেখ নাঈম কাসেম। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করলে হিজবুল্লাহও ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র-রকেট ছোড়া বন্ধ করবে। হামাসের মিত্র হিসেবে আমরা এখন থেকে (ইসরায়েলে) হামলা চালাচ্ছি। গাজায় যদি যুদ্ধবিরতি হয়, অর্থাৎ ইসরায়েলি বাহিনী যদি সেখানে অভিযান বন্ধ করে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে হামলা বন্ধ করে দেবো। আমাদের আর কোনো শর্ত নেই বলে এপিকে জানান শেখ নাঈম কাসেম। গত ৭ অক্টোবর থেকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার এবং মিসর। কাতারের মাধ্যমে গত মার্চ মাসে ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল হামাস। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল যদি গাজা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে নিজেদের হাতে থাকা অবশিষ্ট ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে এই জিম্মিদের ধরে এনেছিল গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী এই রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা। শুরুর দিকে অবশ্য হামাসের প্রস্তাবকে পাত্তা দিতে চাননি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছিলেন, গাজায় অভিযানরত ইসরায়েলি বাহিনীর মূল লক্ষ্য হামাসকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলা এবং এই প্রস্তাব সেই লক্ষের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।