বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেওয়ার ধারায় ভাটা পড়েছে; আগের ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধেই ডলার যাচ্ছে বেশি, যা চাপ তৈরি করছে রিজার্ভেন। চলতি পঞ্জিকা বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে বেসরকারি খাতের কোম্পানি ও উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণদাতা কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছেন ৮ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে আগের নেওয়া ঋণ সুদসহ পরিশোধ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এ খাতে এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ বিদেশি ঋণ কম এসেছে। এপ্রিলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। মে মাসে যা ছিল ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে মে মাসে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মে মাসে যে ঋণ এসেছে এর চেয়ে ১২ কোটি ডলার বেশি বিদেশের উৎসগুলোতে ফেরত গেছে। আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার সংকট তৈরি হওয়া, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের দর স্থিতিশীল না হওয়া, রিজার্ভ সংকট, উচ্চ সুদহারের কারণে বিদেশি ঋণ নিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি আসা অর্থনীতির জন্য ভালো। কম আসলে সংকট তৈরি হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সামির সাত্তার বলেন, করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে ডলার সংকট দেখা দিলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যবসার বর্তমান ও সামনের দিনের অবস্থা পর্যালোচনা করছেন। কারণ ব্যবসায়িক খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। বেসরকারি খাতে স্বল্প মেয়াদী যে বিদেশি ঋণ নেওয়া হয় তা ব্যবসায়ীদের ডলারেই পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দর গত ২ বছরে প্রায় ৩৫ শতাংশের উপর বেড়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২২ সালের শুরুর দিকে ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ পেত মাত্র ৪ শতাংশ সুদে। তখন ব্যাংকগুলো টাকায় ঋণ নিতে পারত ৯ শতাংশ সুদে। ওই বছরে বড় সময়জুড়ে সোফর রেট ছিল ১ শতাংশেরও কম। এরসঙ্গে ব্যাংকগুলো আরো ৩ শতাংশ সুদ যোগ করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে সোফর রেট সাড়ে ৫ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া আরো ৪ শতাংশ ব্যাংকগুলো চার্জ করতে পারবে। ফলে সোফার রেট ১০ শতাংশের উচ্চ সুদহারে পৌঁছেছে। তার ভাষ্য, এ উচ্চ সুদহারের কারণেই ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়েছে।
বিভিন্ন বিদেশি উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের নেওয়া সর্বোচ্চ ১ বছর মেয়াদের জন্য তহবিল ঋণ ’স্বল্পমেয়াদি ঋণ’ হিসেবে ধরা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য আমদানিকারকরা বিদেশি ঋণদাতাদের থেকে ঋণ নেন, যা বায়ার্স ক্রেডিট নামেও পরিচিত। আমদানি দায় পরিশোধে ব্যাংকগুলোও বিদেশি উৎস থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকে। আর্থিক হিসাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্বল্পমেয়াদি ঋণ, যারমধ্যে রয়েছে- বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফারড পেমেন্ট (বিলম্বে মূল্য পরিশোধ), ব্যাক-টু-ব্যাক বিদেশি ঋণপত্র (এলসি) এবং বাণিজ্য অর্থায়নে স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো।
ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে এমন ঋণ নিতে সতর্কতা অবলম্বন করছেন তা নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে সতর্ক অবস্থায় থেকে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে তো বোঝার চেষ্টা করছেন।
এ কারণে ঋণ আসার প্রবণতা কমে যাওয়ায় আগের ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধের পরিমাণ বেশি হয়ে পড়ছে। অর্থনীতির বিশ্লেষক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ফিচ রেটিংসের মত বিদেশি সংস্থা বাংলাদেশকে রেটিং দেয় সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের রেটিং পর্যালোচনা করে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশে ডলার সংকটের বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পর্যালোচনা করছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল রেটিং এজেন্সিগুলো আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ঋণমান অবনমন করায় বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমাদের ক্রেডিট লাইন সীমা কমে গিয়েছে। এটাও অন্যতম কারণ।’
ঋণ কমে যাওয়ার আরেক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এছাড়া বাংলাদেশের কোম্পানিকে ঋণ দিলে সেটা সময়মত তা ফেরত পাবে কি না সেই বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন তারা। যে কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছা করলেও যে সব সময় বিদেশি ঋণ পাবে এখন বিষয়টি এতো সহজও নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম এসেছে ১১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার; শতাংশের হিসাবে যা ৩০ শতাংশ কম।
২০২৩ সালে এমন ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২২ সালে যা ছিল ৩৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
অপরদিকে ২০২৩ সালে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে গত বছরেও স্বল্পমেয়াদি ঋণ যা এসেছে তার চাইতে বেশি পরিমাণ ডলার বাইরে চলে গেছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঋণ আসার চেয়ে শোধ বেশি করলে রিজার্ভের উপচাপ তৈরি হয়। অর্থনীতির জন্য এ সময় বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের দরকার আছে। ডলারের দরকে স্থিতিশীলতায় আনতে হবে। না হলে বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ কম করবেন।’