বগুড়া শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার থাকায় রথের চূড়ার উচ্চতা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে রথযাত্রা আয়োজক কমিটিকে সতর্ক করা হয়েছিল। আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সড়কে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থানভেদে রথের চূড়া ওঠানামা করবে। কিন্তু তা শোনেননি আয়োজকরা। রথের চূড়ার রডটি উঁচু করেছিলেন তারা। সেই রথের রডের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক ধর্মাবলম্বী মানুষ। গতকাল সোমবার গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আয়োজক কমিটির ভুলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবু দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ও পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রবিবার রাতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পিএম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে পুলিশ সুপারের, বিদ্যুৎ বিভাগের, সিভিল সার্জনের ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে তাদের। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, মৃত ব্যক্তিদের লাশ সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গত রোববার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকার আমতলা মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। আহত অবস্থায় ৩৮ জনকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল ও পাঁচজনকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান, জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিকাল ৫টার দিকে সেউজগাড়ি শ্রীশ্রী ইসকন মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমতলা মোড়ে পৌঁছালে রথের চূড়ার সঙ্গে রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তার ও রথের চূড়ায় আগুন ধরে যায়। বিদ্যুতায়িত হন রথ ধরে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ। মারা যান পাঁচ জন। মারা যাওয়া পাঁচ জন হলেন শিবগঞ্জ উপজেলার কুলুপাড়া গ্রামের মৃত নারায়ণ কুমারের ছেলে অলক কুমার সরকার (৪২), সদরের তিনমাথা রেলগেট এলাকার লঙ্কেশ্বরের স্ত্রী আতশি রানী (৪০), শাজাহানপুরের গোহাইল গ্রামের সুদেবের স্ত্রী রঞ্জিতা মোহন্ত (৬০), আদমদীঘির কুন্দগ্রামের ভবানী মোহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০) ও সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি রানী সাহা (৪০)। জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বছরে দুই দফা রথযাত্রা ও উল্টো-রথযাত্রা বের হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান অনুযায়ী ঠিক কত ফুট উচ্চতায় রথ উঠানো যাবে, তা নিয়ে আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া উঠানো হয়। রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব ছিল একজনের হাতে। কিন্তু তার ভুলেই ঘটে গেলো মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা। আয়োজকদের ভুলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল। দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রথযাত্রা আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘বহুদিন ধরে বগুড়া শহরে রথযাত্রা ও উল্টো-রথযাত্রা উৎসব হয়ে আসছে। অতীতে কখনও এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। রথযাত্রার সবকিছু দেখভাল করতে কমিটির পক্ষ থেকে ১০০ জন সেবক নিয়োগ ছিলেন। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যাতে রথের স্পর্শ না লাগে, এজন্য রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমতলা মোড়ে ভুলক্রমে রথের চূড়া নিচে নামানোর আগেই বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লেগে আগুন ধরে যায়। রথে হাত রাখা সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে থাকা অলোক কুমার ঘটনাস্থলেই মারা যান। সুশান্ত দাসের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা সতর্ক ছিলাম, দায়িত্বে অবহেলা ছিল না কারও।’ একই বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া শহর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি পরিমল প্রসাদ রাজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে এটি দুর্ঘটনা। অন্য কিছু নয়। প্রায় ১৫ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের অংশগ্রহণে রথযাত্রা পুলিশ লাইন্স-সংলগ্ন মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হয়। ১৫ মিনিটের মাথায় সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে পৌঁছালে রথের চূড়ার সঙ্গে রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রথের চূড়ায় আগুন ধরে যায়। বিদ্যুতায়িত হন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ। অনেকে পদদলিত হয়ে আহত হন।’ নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নাফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমতলা মোড়ে ১২ মিটার উচ্চতার ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন আছে। রথের চূড়ার রড আরো উঁচু ছিল। এ কারণে সঞ্চালন লাইনে লেগে পুরো রথ বিদ্যুতায়িত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। খবর পাওয়ার পরপরই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল।’