গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি এবার ‘হাজল’ পদ্ধতিতে দেশি জাতের মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও পালন করে এখন স্বাবলম্বী কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ৬ গ্রামের অন্তত ৩ হাজার নারী। তাদের পরিবারের জন্য আমিষসহ পুষ্টিচাহিদা মিটিয়ে এখানকার উৎপাদিত ১ হাজার ২৬ টন দেশি মুরগি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে যাচ্ছে প্রতি বছরেই। আর তা থেকে আয় হয় প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। গৃহস্থালীর পাশাপাশি এখানকার প্রতিটি নারী প্রতি মাসে আয় করছেন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা, কাঞ্চনপুর, শ্যামপুর, পাইকপাড়া, ইচ্ছাখালী ও শিংদহ নিয়ে গঠিত উপজেলা কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাঁওতা ব্লক। এখানকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এলাকার ২ হাজার ৮৫০টি কৃষক পরিবারের অন্তত ৩ হাজার মহিলাকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ছয়টি কৃষি পাঠাগার। তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘হাজল’ পদ্ধতিতে দেশি জাতের মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও লালন-পালনে দক্ষ করে গড়ে তোলেন তিনি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের প্রত্যেকের বসতবাড়ির উঠানে একটি করে মুরগির (তিনতলা) ঘর ও বসবাসরত ঘরের মধ্যে ডিম ফোটানোর জন্য একটি-দুটি করে হাজল তৈরি করা হয়। যেখানে প্রতি মাসে প্রত্যেকটি বাড়িতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই বাচ্চা উৎপাদন করা হচ্ছে। সেগুলো লালন-পালনের মধ্যদিয়ে ২ হাজার ৮৫০টি বাড়িতে প্রতি বছরে গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে ১ হাজার ২৬ টন দেশি জাতের মুরগি। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী এলাকা থেকে মুরগিগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যান রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে। বিক্রি করে প্রতি বছরে আয় করছেন অন্তত দুই কোটি টাকা। কাদামাটি, পাটের আঁশ, বিচালি-চূর্ণ একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ ইঞ্চি গভীর, ২-৩ ইঞ্চি পুরো এবং ১৩-১৪ ইঞ্চি গোলাকার ব্যাসার্ধ পরিমাপের হাজল তৈরি করার পর রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হয়। হাজলে মুরগি বসানোর আগে এক থেকে দুই ফোঁটা কেরোসিন তেলের সঙ্গে পরিমাণমতো ছাই মিশিয়ে মুরগিকে গোসল করানো হয়। যাতে কুচে মুরগিকে উকুন জাতীয় কোনো প্রকার ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করতে না পারে। এরপর মুরগির ওজনের অর্ধেক ওজনসম্মত পরিমাণের সমআকৃতির ডিম নির্বাচন করতে হবে এবং কুচে মুরগি হাজলে বসানোর ২১ দিন পর বাচ্চা ফুটে বের হবে। ১২-১৪ দিন পর মা মুরগিকে বাচ্চা থেকে আলাদা করতে হবে। এই প্রযুক্তিতে একটি দেশী মুরগি বছরে ৬ বার ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করে থাকেন। উপজেলার শিংদহ গ্রামের আমেনা, ফাতেমা, রোজিনা, জান্নাতুল ও সাহেলা খাতুনসহ স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীরা বললেন, প্রতি ১ মাস অন্তর স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী আমাদের বাড়িতে এসে মুরগি কিনে নিয়ে যান। সংসারে উপার্জনক্ষম তেমন কেউ না থাকলেও এ কাজ করে আমাদের সন্তানদের পড়া-লেখা শেখানোসহ সংসার চলে যায় ভালোভাবেই। খাওয়া-পরার পাশাপাশি মুরগি ও ডিম বিক্রি করে ২টি ছাগল, ১টি গরু কিনেছি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানকার ৬ গ্রাম থেকে মুরগি সংগ্রহ করে আমরা মাসে একবার ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। কৃষি কাজের পাশাপাশি এ ব্যবসা করে আমরা বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করছি। কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক চন্ডীদাস কুন্ডু বললেন, মুরগি পালনে প্রশিক্ষণ দেয়া পশুসম্পদ অধিদপ্তরের কাজ করার কথা থাকলেও দেশের উন্নয়নকল্পে আমাদের উদ্যোক্তা বকুল হোসেনের কর্মকান্ড শুধু যশোর অঞ্চল নয়- গোটা দেশেই নজিরবিহীন। মাংসের চাহিদা পূরণে দেশের বাইরে থেকে মুরগির বিভিন্ন প্রজাতি আমদানি করা হচ্ছে আমাদের দেশে। সেগুলো পালনের মধ্যদিয়ে মাংসলরূপে আবাদ করতে রাসায়নিকসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর কারণে দেখা দেয় জটিল রোগ-ব্যাধি। এ সত্ত্বেও এ আবাদি প্রভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশে। তাই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সাঁওতা ব্লকের নারীদের এ কর্মকাণ্ডকে সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এরইমধ্যে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের উপ-পরিচালককে তাদের সব উপজেলার কৃষক পরিবারের নারীদের নিয়ে এখানে পরিদর্শনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি। এভাবে সমগ্র বাংলাদেশের নারীদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই বাইরে থেকে মুরগির আমদানিনির্ভরতা থেকে উঠে আসা যাবে সহজেই। রোগ-ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাবো আমরা, দেশের অর্থনীতিও হবে সমৃদ্ধ। উদ্যোক্তা বকুল হোসেন বলেন, দেশে আমিষ জাতীয় খাদ্য মাংসের চাহিদা পূরণ করতে বাইরে থেকে আমদানি করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মুরগি। এগুলোকে কেমিক্যাল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ায়ে মাংসলরূপে গড়ে তোলার কারণে মানবদেহে জটিল রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। তাই কুমারখালী কৃষি-সম্প্রসারণ অধীন সাঁওতা ব্লকে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশি মুরগি পালনকে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি পরিবারের নারীদের উদ্বুদ্ধ করি। এখন যেভাবে মুরগি ও ডিম উৎপাদন হচ্ছে এভাবে সারা দেশের নারীদের প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জোগাতে পারলে আমদানিনির্ভরতা থেকে রক্ষা পাবে দেশ। ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানি থেকে রক্ষা পাবে দেশের মানবসম্পদ।