ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রী হলেন টিউলিপ সিদ্দিক
বাংলাদেশি ও ইংল্যান্ডের বাঙালিদের অভিনন্দন ও উচ্ছ্বাস
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মন্ত্রী হলেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি টানা চতুর্থবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি। তিনি স্যার কেয়ার স্টারমারের নতুন সরকারে নগরমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন। সিটি মিনিস্টার হিসেবে মন্ত্রিত্বের মাধ্যমে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের আর্থিক পরিষেবা খাত তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করবেন। নতুন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গত সপ্তাহের যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে জয় পায় লেবার পার্টি। লন্ডনের হ্যামস্টেড ও হাইগেট আসনে ২৩ হাজার ৪৩২ ভোট পেয়ে টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ী হন টিউলিপ সিদ্দিক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডন উইলিয়ামস ৮ হাজার ৪৬২ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। এর আগে হ্যামস্টেড ও কিলবার্ন আসনে টানা তিনবার এমপি হয়েছিলেন তিনি। তিনি লেবার পার্টির এমপি হিসেবে ছায়া মন্ত্রী হয়ে কাজ করছিলেন। এবার তাকে নগরমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে দল। টিউলিপ ২০২১ সাল থেকে লন্ডনের সিটি অব ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টে কাজ করেছেন।
দুই কন্যার মন্ত্রিত্বে উচ্ছ্বসিত বিলেতের বাংলাদেশিরা। এদিকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত বিলেতের বাঙালিরা। স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
নিউহাম কাউন্সিলের সিভিক মেয়র রহিমা রহমান ও কাউন্সিলার মুজিবুর রহমান জসীম বলেন, ‘ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের জন্য সত্যিই একটি গর্বের মুহূর্ত। কারণ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রিসভায় দুজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এমপি নিয়োগ পেয়েছেন। রাজনীতির মূলধারায় তাদের নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা।’
ক্রয়েডন কাউন্সিলের লেবার গ্রুপের লিডার ও কাউন্সিলার মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, ‘আসুন আমরা এই মাইলফলকটি উদযাপন করি। কারণ তারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন।’ ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতীয় ও পাকিস্তানি কমিউনিটি বহু আগেই ব্রিটেনে মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। রোশনারা আলী ও টিউলিপ সিদ্দিকের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাওয়া দেরিতে হলেও নিঃসন্দেহে ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের বড় অর্জন।’
টিউলিপ ও রোশনারাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নেতারাও। ড্যাগেনহাম অ্যান্ড রেইনহামের কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান মাহদী বলেন, ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুজন এমপিকে ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রিসভায় দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত ও গর্ববোধ করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এর আগে দেখেছি, লন্ডনের মেয়র পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য অনেক অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো এমপি কখনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাননি। এ হিসেবে এটি আমাদের জন্য নতুন এক ইতিহাস। যদিও আমি কনজারভেটিভ পার্টির অ্যাক্টিভিস্ট। তারপরও আমি একইভাবে আনন্দিত বাংলাদেশিদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ায়। মনে হয় এই অনুপ্রেরণা বাকি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।’
বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি ডেজলিং ডনের কমিউনিটি এডিটর সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম খসরু বলেন, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লন্ডনের মেয়র দেখব, প্রধানমন্ত্রী দেখব। ছোট ছোট আশা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন দিয়েই শুরু হয়। কখনো দেরিতে হয়, আবার কখনো তাড়াতাড়ি স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। আমরা সেই আশায় দিন গুনছি। যেদিন বাংলাদেশি রাজনীতিকদের ব্রিটিশ রাজনীতির উচ্চ আসনে দেখতে পাব। রুপা হকের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে রাজনীতিতে আসা টানা চারবারের এমপিও আগামীতে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাবেন বলে আমরা আশাবাদী।’
রোশনারা আলী ও টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সরকারে স্থান পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়ে লন্ডনের ব্রিকলেনের বাংলাটাউনে গতকাল বুধবার আনন্দসভার আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক দর্পণ সাময়িকীর সম্পাদক রহমত আলী বলেন, রোশনারা আলী ও টিউলিপি সিদ্দিক মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার আনন্দে এই আয়োজন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তরাজ্য সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় ট্রেজারি বিভাগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (ট্রেজারি বিভাগের অর্থমন্ত্রী এবং সিটি মিনিস্টার) হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। লেবার পার্টির টিকিটে টানা চতুর্থবার নির্বাচিত এই এমপি এবার হ্যামস্টেড ও হাইগেট আসন থেকে ২৩ হাজার ৪৩২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এর আগে ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে হ্যামস্টেড ও কিলবার্ন আসনে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের প্রথম ও পাঁচবারের এমপি রোশনারা আলীকে গৃহায়ন, কমিউনিটি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এবার তিনি লন্ডনের বাংলাদেশি-অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি আসন থেকে ১৫ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্রেক্সিট, ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে থাকা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি খাতের পুনর্গঠন নতুন লেবার সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি। যুক্তরাজ্যের সিটি অব লন্ডন এবং বৃহত্তর আর্থিক পরিষেবা শিল্পের দায়িত্বশীল সিটি মিনিস্টারের পদটির দায়িত্বগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ, ক্রিপ্টো সম্পদ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা নীতি অন্তর্ভুক্ত। সিটি মিনিস্টারের পদ হলো যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যম স্তরের মন্ত্রীর পদ।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের টানা চারবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তবে টিউলিপ সিদ্দিক রাজনীতিতে নাম লেখাবেন সেটা মা হিসেবে এক সময় চাননি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা। বেসরকারি একটি টেলিভিশনে দেওয়া তার ভাষ্য, রাজনীতির মাঠে টিউলিপ যে সফলতা পেয়েছেন, তাতেও মা হিসেবে তার কোনো ‘অবদান নেই’। আমি চাচ্ছিলাম সে টিচার হোক, জজ-ব্যারিস্টার হোক বা অন্য কিছু হোক। কিন্তু রাজনীতিতে সে চলে গেছে, এখানে আমার অবদান নেই- সম্পূর্ণ তার নিজের চেষ্টায়। মা হিসেবে আমার যতটুকু করার, মা হিসেবে সন্তানকে যেভাবে দেখার- আমি সেভাবেই দেখি। টিউলিপ রাজনীতিতে এসেছে তার নিজের ইচ্ছায়।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেন টিউলিপ, যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন।
শেখ রেহানা বলেন, আমার মেয়ে আবার এমপি নির্বাচিত হলো। মানুষের সেবা যেখানে দরকার, সেখানেই নিষ্ঠার সাথে করবে। শুধু নির্বাচনের সময় সে কাজ করেনি এলাকায়, সারাবছরই কাজ করে। সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালন করে অন্য লোকের সেবা করা- বিদেশে যেটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
একদিকে পারিবারিক পরিচয়, অন্যদিকে লন্ডনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে প্রার্থিতার কারণে টিউলিপ সব সময়ই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। ৪১ বছর বয়সি টিউলিপ সিদ্দিককে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। টিউলিপের মা বলেন, সে তার জীবনটা উৎসর্গ করেছে ইথিকসের রাজনীতিতে। পরিচয় তার প্রয়োজন হয় না। সবার কাছে দোয়া চাই, সে যেন তার কাজ সততা, নিষ্ঠার সাথে করতে পারে। মানুষের সেবা যেখানেই যে এলাকায় হোক- শুধু নির্বাচনি এলাকায় না, যেখানেই অসহায়ের পাশে সে থাকবে। এবং সবার সেবার জন্য তার জীবন নিয়োজিত করবে। সবার কাছে দোয়া চাই যেন সে (টিউলিপ) সবসময় সৎভাবে থাকতে পারে।