বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন

লেজেগোবরে ঢাকা মহানগর বিএনপি!

* যুবদলের নতুন কমিটি নানা আলোচনা-সমালোচনা * ভবিষ্যৎ আন্দোলনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি থেকে বিতর্ক যাচ্ছেই না। এবার নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে দলটির কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে। গত রোববার (৭ জুলাই) ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ বিএনপিসহ বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ব্যর্থতার কারণে বিলুপ্ত করা কমিটিগুলোর নতুন নেতৃত্বে রেখেছে পুরনোদেরও। ঘোষিত এই কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এসব কমিটির মধ্যে ঢাকা মহানগরের দুই অংশের নেতৃত্বে এসেছেন আন্দোলনে ব্যর্থতার অভিযোগে ভেঙে দেওয়া পুরাতন কমিটির শীর্ষ নেতাদের একাংশ। যার ফলে কমিটি ঘোষণার পর থেকে বিএনপি নেতাদের মধ্যে চলছে নানা সমালোচনা। একাধিক নেতা প্রশ্ন তুলছেন- তাহলে কী ভেঙে দেওয়া কমিটির এক নেতা ব্যর্থ আরেক নেতা সফল ছিলেন? এছাড়া গত মাসে ঈদুল আজহার আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতেও বেশ কয়েকজনকে পদোন্নতি-অবনতি করা হয়। কয়েকজনকে নতুন করে সম্পৃক্তও করা হয়। সেখানেও অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সব মিলিয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপি যেনো লেজেগোবর অবস্থায় বিরাজ করছে। দলটির একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রবীণ ও তারুণ্যের সমন্বয়ে কমিটি না হওয়ায় অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নেতারা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় পড়েছেন। ঢাকা মহানগরে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি রয়েছে নানা অভিযোগ ও ক্ষোভ। কেউ কেউ হতাশার কথাও বলছেন। বরিশাল মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের অধিকাংশই ক্ষুব্ধ। আর চট্টগ্রাম মহানগরেও একপেশে কমিটি গঠন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘোষিত কমিটিতে- ঢাকা মহানগর উত্তরে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক হয়েছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, সদস্য সচিব করা হয়েছে দলের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল হককে। দুই সদস্যের দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবীনকে। বরিশাল মহানগরে তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে মনিরুজ্জামান খান ফারুককে। তিনি সাবেক কমিটিরও আহ্বায়ক ছিলেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়াকে। তিনি সাবেক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে আফরোজা খানম নাসরিনকে। তিনি আগের কমিটির সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগরে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহকে এবং সদস্য সচিব করা হয়েছে নাজিমুর রহমানকে। নবগঠিত চার আহ্বায়ক কমিটিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

বিগত ঈদুল আজহার দু’দিন আগে গত ১৪ জুন ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম ও সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডলার ও সদস্য সচিব আমিনুল হক, চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক ডা. সাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর এবং বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ও সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবিরের নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ঈদের আগে আকস্মিকভাবে মধ্যরাতে কমিটি ভেঙে দেওয়ায় দলের ভেতর ও বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও হয়।

জানা গেছে, আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম ভ্যানগার্ড ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্তের পর থেকে পদপ্রত্যাশী নেতারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু এবার সেই দৌড়ঝাঁপ খুব বেশি কাজে লাগেনি। বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, তাদের প্রত্যাশা ছিল অন্তত ঢাকা মহানগর কমিটিতে সিনিয়র-জুনিয়র সমন্বয় করে কমিটি দেওয়া হবে। সেখানে কমিটির গুরুত্ব বাড়বে বলে তারা মতও প্রকাশ করেন। তবে ঘোষিত কমিটিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি। ঢাকা মহানগর বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে এরকম জুনিয়র নেতা দিয়ে কমিটি গঠন এবারই প্রথম বলে মনে করছেন নেতারা। এর আগে অবিভক্ত ঢাকা মহানগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মির্জা গোলাম হাফিজ, লে. জে. (অব.) মীর শওকত আলী, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মতো হেভিওয়েট নেতারা দায়িত্ব পালন করেছেন। সে তুলনায় এবারের কমিটি অনেকটা তারুণ্যনির্ভর ও জুনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে করা হয়েছে বলে অভিমত নেতাদের। তারা বলছেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তারুণ্যকে সম্পৃক্ত করতে পারলে আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু মহানগর কমিটিগুলোর গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পেত।

আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে বিগত দিনে ঢাকার প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে পরস্পরবিরোধী বড় দুটি বলয় ছিল। এবার আব্বাস বলয় হিসেবে পরিচিত দু’জনকেই নতুন কমিটির নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে পরবর্তী কমিটিতে খোকা বলয়ের অবস্থান কেমন হবে- সেটা দেখার অপেক্ষায় কর্মীরা। যদিও বিগত আন্দোলনে খোকা বলয়ের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা নাখোশ হাইকমান্ড। তবে খোকার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন নিজের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছেন। এদিকে আন্দোলনকালীন মজনু এবং রবীন ও তার বাবা সালাহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন কারাগারে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি বলেন, আমি কথা বলতে পারব কি না, কথা বলার পরিস্থিতিতে আছি কি না সেটা আগে জানতে হবে। একথা বলে তিনি কল কেটে দেন।

সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটির দুই নেতা মজনু ও তানভীর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ। অথচ আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়ে মির্জা আব্বাসকেও বিদায় নিতে হয়েছিল। এখন তার অনুসারীরা সফল হবেন কি না সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ঢাকা মহানগরের নতুন দুই কমিটির শীর্ষ চার নেতার মধ্যে তিনজনই গত কমিটিতে শীর্ষ পদে ছিলেন। এ ছাড়া নতুন করে যুক্ত হওয়া যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবও ব্যর্থতার অভিযোগে যুবদল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- নতুন কমিটি দিয়ে কার্যকর কিছু হবে নাকি এটা হোম ওয়ার্ক?