রোহিঙ্গা নবী হোসেনের প্রধান সহযোগী ‘জোবায়ের’

কক্সবাজার কারা হাসপাতালে রয়েছে রাজারহালে

* জননিরাপত্তা হুমকির মুখে * অর্থের বিনিময়ে কারা হাসপাতালে থাকছেন অস্ত্র, মাদক ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের লোকজন * ২০ জনের ধারণক্ষমতায় থাকছেন ৬০-৭০ জন * মাসে লাখ লাখ টাকা সিট বাণিজ্য, কার পকেটে যায় এতো টাকা?

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের নিয়ন্ত্রিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোহাম্মদ জোবায়েরসহ অনেক দাগী অপরাধী কক্সবাজার কারা হাসপাতালে রাজারহালে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে কারা হাসপাতালে রাখার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সচেতন মহল। ২০ জনের ধারণক্ষমতায় কারা হাসপাতালে অর্থের বিনিময়ে থাকছেন ৬০-৭০ জন মানুষ। কারা হাসপাতালে শুধু সন্ত্রাসী নয়, অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের লোকজনও থাকছেন। বছরের পর বছর কক্সবাজার জেলা কারাগারে কারা হাসপাতালে সিট বাণিজ্য চলছে। ওই সিট বাণিজ্যের অর্থ যায় কার পকেটে? বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. শাহ আলম খান বলেন, অজান্তেই কারা হাসপাতালে জুবায়ের ছিল। নানাভাবে জানতে পেরে গত দুই দিন আগে তাকে সেলে রাখা হয়েছে।

কারা হাসপাতালে দায়িত্বরত একাধিক কারারক্ষী ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল ১৪ এপিবিএন অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোহাম্মদ জোবায়েরকে চার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেন। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি বিদেশি পিস্তল, দুটি ওয়ান শুটারগান, ৩ রাউন্ড বড় ফাইভস্টারের গুলি, ৭ রাউন্ড মাঝারি ফাইভস্টারের গুলি, ২ রাউন্ড মাঝারি ফাইভস্টারের গুলি, ৪ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ২ রাউন্ড শর্টগানের কাতুর্জ এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। পরদিন সহযোগীসহ তাকে আদালতে তোলা হলে আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত চার মাস ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মোহাম্মদ জোবায়ের রাজারহালে কারা হাসপাতালে রয়েছে। একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী কারাগারের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় বাংলাদেশি নাগরিকদের সাথে অবস্থান করায় কারা হাসপাতালে অনেকটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এছাড়া কারা হাসপাতালে অস্ত্র, মাদক, চোরাচালানসহ নানা অপরাধীরা অর্থের বিনিময়ে জামাই আদরে রয়েছেন।

কক্সবাজারের এক সাবেক সংসদ সদস্য আক্ষেপ করে জানিয়েছেন, কক্সবাজার কারাগারে সব অনিয়মই নিয়ম। অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান, হত্যাসহ অসংখ্য মামলার আসামি কারা হাসপাতালে রয়েছে। এমনকি সরকারবিরোধী আন্দোলনের একজন বিএনপির শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারা হাসপাতালে রাজারহালে থাকছেন। ওই বিএনপি নেতা একজন কেন্দ্রীয় বিএনপির আত্মীয় বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তথ্যের স্বার্থে স্পর্শকাতর মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে আদালতে রিমান্ডে আবেদন করা হয়। অনেক সময় আদালত জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে দেখা যায়, অধিকাংশ অস্ত্র, মাদক, হত্যাসহ নানা অপরাধের আসামিরা কারা হাসপাতালে থাকছেন। বিষয়টি দেখে আমরাও হতবাক হই।

কারাগারের নানা বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কারা ফটকে দেখা হয় সরকারবিরোধী আন্দোলনের জামিনপ্রাপ্ত বিএনপি-জামায়াত নেতাসহ অনেকের সাথে। কারাগারে কেমন ছিলেন জানতে চাইলে জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা বলেন, কোনো ঝামেলা ছাড়াই ছিলাম। আরাম আয়েশ ছিল। টাকা দিলে সব মিলে কক্সবাজার কারাগারে। একই কথা জানালেন জামিনপ্রাপ্ত একাধিক মাদক, অস্ত্রসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার মামলার আসামি।

কারা হাসপাতালে সিট বাণিজ্য, একদিনে যে রেট, একমাসে সেই রেট : অনুসন্ধান করে জানা গেছে, অর্থের বিনিময়েও কারা হাসপাতালে সুস্থ মানুষ থাকার সুযোগ রয়েছে। মামলার ধরনের উপর নির্ভর করে সিট বিক্রি হয়। মাঠ পর্যায়ে কারা হাসপাতালে ডাক্তার, ফার্মাসিস্টের নির্দিষ্ট দালাল রয়েছে। তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে আদালতে আসার পর চুক্তি হয়। জেলে পৌঁছালে জামাই আদরে তারা চলে যায় কারা হাসপাতালে। কারা হাসপাতালে সুবিধা পাওয়া কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কারা হাসপাতালে একদিনে যে রেইট, একমাসেও সে রেইট। কতো দিতে হয় জানতে চাইলে তারা বলেন, সাধারণ আসামি প্রথমে ১৫- ২০ হাজার। মাদক, অস্ত্র, হত্যা মামলার আসামি হলে একটু রেট বেশি। তাদের তথ্য মতে, অনেক সময় একটি সিট পাঁচবারও বিক্রি হয়।

কক্সবাজার জেলা কারাগারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য : গতকাল কক্সবাজার জেলা কারাগারে জেল সুপার মো. শাহ আলম খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার অগোচরে ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোহাম্মদ জোবায়ের কারা হাসপাতালে ছিল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারি সে বড় মাপের সন্ত্রাসী। দুই দিন আগে তাকে বের করে সেলে রাখা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, জেল কোড অনুযায়ী কোনো অপরাধী জেলে আসার সময়, কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক ফরোয়ার্ডিং দেয়ার কথা থাকলে তা দেয় না। যার কারণে অনেকেই হাসপাতালে থাকার সুযোগ পায়। শুধু, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নয়, বর্তমানে কারা হাসপাতালে ৬০-৭০ জন অপরাধী রয়েছে দাবি করা হলে তিনি বলেন, এসব বাদ দেন, আপনার কাছে তথ্য থাকলে তালিকাটি দিয়েন।

কক্সবাজার জেলা কারাগারে ফার্মাসিস্ট মো. হামিদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এক সপ্তাহের জন্য রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জোবায়ের কারা হাসপাতালে ছিল। সে বর্তমানে নেই বলে দাবি করেন। কারা হাসপাতালে কতজন থাকতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধারণক্ষমতা ২০ জনের। ৬০-৭০ জন্য কীভাবে থাকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিকদেরও তদবির থাকে। অর্থের বিনিময়ে অপরাধীরা থাকেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ-মহাপরির্শক টিপু সুলতানের বক্তব্য : গতকাল আলোকিত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কারা উপ-মহাপরির্শক টিপু সুলতানের সাথে যোগাযোগ করে কারা হাসপাতালের প্রসঙ্গে বলা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে বলেন, বিষয়গুলো তো আমার নজরে আসেনি। খোঁজ নিচ্ছি। ফের রোববার অফিস টাইমে যোগাযোগ করতে বলেন এই কর্মকর্তা।

প্রতিবেদককে ম্যানেজের চেষ্টা : গতকাল দুপুরে বক্তব্য নেয়ার পর প্রতিবেদককে ম্যানেজ করা চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ওইদিন সন্ধ্যায় প্রতিবেদকের মুঠোফোনের নাম্বারে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে একটি অঙ্কের এসএমএস আসে। এসএমএস আসার মিনিট পাঁচেক পর কারাগারের দুই কর্মকর্তা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বলেন, কিছু মনে করিয়েন না, আপনার নাম্বারে একটি ম্যসেজ পাঠানো হয়েছে। তাদের প্রেরিত নাম্বার ও অর্থটি প্রতিবেদক সংরক্ষণ করে রেখেছেন। পরে অর্থ প্রেরণের বিষয়টি প্রতিবেদক জেল সুপারের হোয়াটসঅ্যাপে অভিযোগ আকারে বললে তিনি হোয়াটসঅ্যাপ সিন করলেও কোনো উত্তর দেয়নি। তৈরি করা প্রতিবেদনটির ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের বক্তব্যসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

একনজরে কক্সবাজার জেলা কারাগার : ১৯১৭ সালে কক্সবাজার উপকারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী ২৭.০৫.২০০১ তারিখে পুনঃনির্মাণ কাজ শেষে নতুন স্থানে জেলা কারাগার স্থানান্তর করা হয়। কারাগারের মোট জমির পরিমাণ ১২.৮৬ একর, তন্মধ্যে পেরিমিটার ওয়ালের ভেতরে ৮.০৯ একর এবং বাহিরে ৪.৭৭ একর।

কারাগারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলা কারাগারে ধারণক্ষমতায় ৮৩০ জন। তার বিপরীতে গতকাল শনিবার পর্যন্ত রয়েছে ৩ হাজার ২৯০ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান মামলার আসামি।

প্রসঙ্গত, পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র মতে, এরইমধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আরসাসহ ২৭টি গ্রুপ নিয়ে পুলিশ একটি গোপন প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মোহাম্মদ জোবায়েরসহ অনেকের নাম রয়েছে। এই প্রতিবেদনে জোবায়ের প্রসঙ্গে মাদক, অস্ত্রসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।