হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন। এই শোক ও স্মৃতিকে স্মরণ করে সারা বিশ্বে মুসলমানরা আশুরা পালন করেন। আর এরই স্মরণে ১৭ শতকে সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মাণ করা হয় হোসেনি দালান। এটি পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল হোসেনি দালান রোডে অবস্থিত।
প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক এই হোসেনি দালান ইমামবাড়া নামেও পরিচিত। আবার অনেকে হুসনি দালান বা হোসায়নি দালানও বলেন। হোসেনি দালান মূলত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ এবং কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্রভূমি।
হায় হোসেইন, হায় হোসেইন মাতমের মধ্য দিয়ে পবিত্র আশুরার ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল এখান থেকেই বের হয়। এছাড়াও শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালন করা হয়।
হোসেনি দালান বা ইমামবাড়ার দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর এবং উত্তরাংশে রয়েছে কবরস্থান। দালানটি সাদা বর্ণের এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফির কারুকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের ভেতরেও সুদৃশ্য নকশা আছে। মোগল সম্রাট শাজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয় বলা হলেও এর নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।
হোসেনি দালান বা ইমামবাড়ার প্রাচীরের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তার এক নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ এটি নির্মাণ করেন। হিজরি ১০৫২ সনে অর্থাৎ ১৬৪২ খ্রিষ্টব্দের প্রথমে তাজিয়া নির্মাণ করেন তিনি।
পুরো স্থাপত্য তারই পরিবর্ধিত রূপ বলে বিভিন্ন নথিতে পাওয়া যায়। তবে কিছুকাল পর এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে আবার নির্মাণ করেন। জানা যায়, ১৮৩২ সাল পর্যন্ত আদি স্থাপনাটি টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুই দফায় এর সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে এটি পুনঃনির্মাণ করেন। ২০১১ সালে ইরান সরকারের উদ্যোগে পুরো হোসেনি দালানের সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এখনকার হোসেনি দালানে প্রতিফলিত হয়েছে।
১০ মহররম আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালানে শিয়া মুসলমানরা নানা আয়োজন করেন। তাদের আগমনে ইমামবাড়া কানায় কানায় ভরে যায়। আশুরার দিনে তারা রোজা রাখেন। পরে সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করেন। আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালান থেকে প্রতিবছর তাজিয়া মিছিলও বের হয়।
১০ মহররম সম্পর্কে এক ব্যক্তি বলেন, ১০ মহররম পুরো বিশ্বের মুসলমানদের কাছে একটি বিশেষ দিন। এ দিনে মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আবার এ দিনেই ধ্বংস করবেন। এ দিনে হযরত মোহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য তার কষ্ট অনুভব করার জন্য আমরা তাজিয়া মিছিলে নিজের পিঠে আঘাত করি। গতবছর করোনাভাইরাসের কারণে রাস্তায় না নেমে তাজিয়া মিছিল সীমিত পরিসরে মসজিদের (হোসেনি দালান) ভেতরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ বছরও সীমিত পরিসরে তাজিয়া মিছিল হবে।
মহররমের তাজিয়া মিছিল ইরাক ও ইরানে বহন করা হয় না। এই মিছিলের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও জড়িত রয়েছে। কীভাবে শুরু এই মিছিলের?
মহররম পালনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো ‘তাজিয়া’। এই আরবি শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো শোক প্রকাশ করা। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন কারবালার ঘটনা উপলক্ষে শোক পালন করেন। প্রসঙ্গত, আশুরা বা মহররমের দশম দিনে ইমাম হোসেন শাহাদতবরণ করেছিলেন। তাই ওই দিন বলে তার কবরের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল করা হয়। ইমাম হোসেনের কবরের এই প্রতিকৃতির নামই তাজিয়া। পবিত্র কোরানের কোথাও এ শব্দ উল্লেখ নেই। তবে কোনো মৃত ব্যক্তির শোকাহত আত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জানাতে এই শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘তাজিয়া’ শব্দ প্রাথমিকভাবে শাহাদতপ্রাপ্ত ইমামদের জন্য শোক জ্ঞাপন করা বোঝায়। বিশেষ করে ইমাম হোসেনের প্রতি শোক প্রকাশকেই বোঝানো হয়।
ঘটনাক্রমে শিয়া মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল ইরাক ও ইরানে। কিন্তু সেখানে মহররমের শোকমিছিলে তাজিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে যখন মোগল শাসন, তখন শাহ সুজা (১৬৩৯-৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালীন এ অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের ঢাকার নায়েব-নাজিমদের অধিকাংশই ছিলেন শিয়া। সে সময় ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ মীর মুরাদ ঢাকায় হোসেনি দালান নির্মাণ করেন। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থান যেমন মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, অষ্টগ্রাম, সৈয়দপুর, সিলেটে ইমামবাড়া তৈরি করা হয়েছিল।
তাজিয়া মিছিলে বহন করা কবরটি সাধারণত তাজিয়া কাঠ, কাগজ, সোনা, রুপা, মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে ঢাকার হোসেনি দালানের তাজিয়াটি কাঠ ও রুপার আবরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বুক চাপড়ে ও জিঞ্জির দিয়ে পিঠের ওপর আঘাত করে নিজেদের রক্তাক্ত করেন।
এই দিনের মিছিলে কয়েকজন লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ও তরবারি চালাতে চালাতে এগিয়ে যান। ওই সময় দুটি শিবিকা সমেত কিছু লোক অশ্বারোহী সৈন্যের সাজে মাতম করতে করতে এগিয়ে চলেন। তাদের পেছনে থাকে একদল গায়ক। মর্সিয়া গাইতে গাইতে তারা মিছিল অনুসরণ করেন। তার পর থাকে হোসেনের সমাধির প্রতিকৃতি। এভাবে মিছিলটি এগোতে এগোতে আগে থেকে ঠিক করে রাখা স্থানে গিয়ে শেষ হয়।