আন্দোলন-সহিংসতায় রংপুরে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর
সারা দেশের মতো রংপুরেও কোটা আন্দোলনে সহিংসতায় অর্ধশতাধিক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন বলেছেন প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন রংপুর মহানগর এলাকায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুরে বেরোবি ক্যাম্পাসের সামনে পার্ক মোড়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ সময় সংঘর্ষের সম্মুখে থাকা আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। তিনি বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। রংপুরে সহিংসতার ঘটনায় ১২টি মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীসহ শতাধিকের নাম উল্লেখ করে আরো কয়েকশ’ অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে।
গত শুক্রবার বিকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি ক্রাইম ও মিডিয়া উৎপল রায়। আন্দোলনের সময় সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ভিডিও দেখে দেখে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে পড়া দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবের কারণে সারা দেশের মতো রংপুরেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৫-৬ দিনে শুধু মহানগর এলাকাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আরএমসিসিআই)।
দ্রুত দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংগঠনটির নেতারা। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সন্ধ্যায় আরএমসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, গত ১৬ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত রংপুরে অভাবনীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে নাশকতাকারীরা। শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে এটিকে সহিংস করে তোলে অপশক্তি। তাদের নজিরবিহীন নৈরাজ্য, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সম্পদও রক্ষা পায়নি। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকার কারফিউ দিয়েছে।
রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের মতো দোকানপাট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাচ্ছে না। এতে গত ৫-৬ দিনে শুধু রংপুর মহানগর এলাকায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই ধাক্কা সামলে উঠতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলার সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে থাকা, তাজহাট থানা, নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িসহ প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, বিভাগীয় ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ভাঙচুর এবং ৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগে প্রায় ৫ কোটি টাকা, জেলা মৎস্য অফিসের সিসি ক্যামেরাসহ ভবনের ২ লাখ টাকা, বিভাগীয় জেলা ও বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ভাঙচুর, সিসি ক্যামেরাসহ অফিস ভবন ও গাড়ি ভাঙচুরে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং কয়েকটি ছাত্রাবাসের কক্ষ ভাঙচুরে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, র্যাব-১৩ এর একটি ডাবল কেবিন পিকআপে অগ্নিসংযোগ ৬০ লাখ টাকা, বিজিবি রংপুরের দুটি গাড়ি ভাঙচুরে ১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে ২৫ লাখ, মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে ২০ লাখ টাকা, সমবায় মার্কেট ভাঙচুরে ২০ লাখ, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস ভাঙচুর ও লুটপাটে ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তাছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিস, ঢাকা ব্যাংকের বুথ ভাঙচুর ও লুট, জেলা ছাত্রলীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও লুট, মহানগর জাতীয় শ্রমিকলীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, জেলা পরিষদ কমিউনিটি সেন্টার মার্কেট ভাঙচুর, নগরীর রোড ডিভাইডার ভাঙচুর, বঙ্গবন্ধু চত্বর ভাঙচুর, রেলগেট ভাঙচুর করা হয়েছে। এসবে প্রায় আরো কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, সরকারি বেসরকারিভাবে কয়েকটি স্থাপনার ক্ষতি নিরূপণ কমিটির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ক্ষতির তথ্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির শিকার হয়েছে। সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সংশ্লিষ্টরা নিরূপণ করছেন।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন জানান, রংপুর মহানগরীসহ আট জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কারফিউ স্থায়ীভাবে তুলে নেয়া হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিবেচনায় শিথিল সময় ছাড়া অন্য সময়ে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় কারফিউ জারির অষ্টম দিনে গতকাল শনিবার (২৭ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শিথিল। এদিন সকাল ৬টার আগ পর্যন্ত এবং রাত ৯টার পর থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।