মৌসুমের শেষে বিপাকে আমচাষিরা

* বাগানেই পচে নষ্ট হয়েছে আম * অনলাইন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে * কোটা আন্দোলনে শত কোটি টাকার লোকসান

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মসিউর রহমান জেহাদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

মৌসুমের শেষের দিকে আম নিয়ে যেন হতাশা কাটছেই না চাষি-ব্যবসায়ীদের। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছরে আমের ফলন কম। শুরুর দিকে আম দাম নিয়ে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৌসুমের শেষের দিকে চাষিরা আম বিক্রিতে বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন। টানা ১০-১২ দিন পরিবহন বন্ধ থাকায় কপাল পুড়েছে আমচাষিদের। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পাঠানো সম্ভব হয়নি বাগানের আম। ফলে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকার। আমচাষিরা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবহাওয়ার কারণে এবার আমের ফলন কম। নতুন সৃজন হওয়া বাগানগুলোয় আমের ফলন ভালো হলেও পুরাতন বাগানগুলোর গাছে আমই ধরেনি। অথচ এ জেলার প্রায় ৬০ ভাগ আম বাগানই পুরনো। এ অবস্থায় ফলন কম হলেও চাষিরা বেশি দামে আম বিক্রি করতে পারছিলেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমচাষিদের সে সম্ভাবনাটুকুও হারিয়ে যায়। অনেক বাগানে আম পেকে নষ্টও হয়েছে। তাই শুরুর দিকে চাষিরা বেশি দামে আম বিক্রি করতে পারলেও শেষের দিকে এসে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। শিবগঞ্জর আমচাষি মানারুল ইসলাম বলেন, চারটা বাগানের মধ্যে দুটি বাগানে মোটামুটি আমের ফলন হয়েছে। শুরুর দিকে বেশি দাম আম বিক্রি করতে পারলেও শেষের দিকে দরপতন হয়। কোটা আন্দোলনের কারণে এমন ক্ষতি হয়েছে আমার। কিছু কিছু আম বাগানেই নষ্ট হয়েছে। বাজারে ক্রেতা না থাকায় আমও নামাতে পারিনি।

কানসাট আমবাজারের ব্যবসায়ী ইমরান জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে কানসাটের বাজারে। আম সরবরাহ কমে যায়, একই সঙ্গে দামও। যার কারণে অনেক চাষি গাছ থেকে আম নামানো বন্ধ করে দেন। বাজারে ক্রেতা ছিল না বলে আমও কম নামতো।

চলতি মৌসুমে কানসাট আমবজারে দৈনিক ২০-২৫ কোটি টাকার আমের বেচা-কেনা হয়েছে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের ফলে আম পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেচাকেনায় ‘ভাটা’ পড়েছে। এই বাজারের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন, সাধারণত চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাসহ দূরবর্তী জেলায় ট্রাক, পিকআপসহ অন্যান্য বাহনে আম পৌঁছানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় যানবাহনের ক্ষতির আশঙ্কায় মালিকরা ট্রাক-পিকআপের ভাড়া দেয়নি। ফলে প্রতিমণ আমের দাম ৫০০-৭০০ টাকারও বেশি কমে যায়। একই সঙ্গে কানসাট আম বাজারে বেচাকেনা কমে যায়।

ক্ষতির শিকার অনলাইন ব্যবসায়ীরাও : গত কয়েকবছর ধরে অনলাইনে আম বিক্রি করছিলেন গোমস্তাপুরের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন। চলতি মৌসুমে ফলন বিপর্যয় ও দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায় খুব একটা লাভবান হতে পারেননি এই যুবক। তারপরে আকস্মিকভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তার। যার কারণে তিনি সপ্তাহ ধরে আমের ব্যবসা করতে পারেননি। সাহাবুদ্দিন জানান, ফেসবুকে পোস্ট দিলে আমের অর্ডার আসে। আমের ব্যবসার সবকিছুই অনলাইনের মাধ্যমে। কিন্তু ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় আমের অর্ডার নিতে পারিনি। আমরা যারা অনলাইনে আম কেনাবেচা করি তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কোটা আন্দোলনে শত কোটি টাকার লোকসান : আন্দোলন-সংঘাত আর দেশজুড়ে কারফিউ জারির পর আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা অন্তত শত কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে দাবি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি অ্যাসোসিয়েশন। বাগানে আম পচে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে আমের দামে দরপতন হওয়ায় তারা এই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করে এই সংগঠনটি। কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে দৈনিক প্রায় তিনশ ট্রাকে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন আম যায় দেশের বিভিন্ন বাজারে। এই আমের মূল্য গড়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। আন্দোলনের দশদিনে ২৫০ কোটি টাকার আম বেচাকেনার কথা ছিল। কিন্তু আম পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দাম কমে যাওয়ায় অঙ্ক গিয়ে দাঁড়ায় ১৫০ কোটির ঘরে। ফলে ওই ১০ দিনে চাষি ও ব্যবসায়ীদের ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি বিপণনের কর্মকর্তা মোকাব্বের আলম নাঈম বলেন, কোটা আন্দোলনের ফলে আম বেচাকেনা কম হয়েছে। সব কিছু শেষ হয়ে গেলে চাষিরা আবারো ব্যবসা করতে পারবেন এবং তারা তাদের নায্য দাম পাবেন।