গত এক সপ্তাহে ওষুধের দাম বাড়েনি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো অযুহাতে ওষুধের দাম বেড়ে থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে অধিকাংশ ফার্মেসির দোকান ছিল বন্ধ। তালা ঝুলছিল ফার্মেসিগুলোতে। ক্রেতাশূন্য হওয়ায় বেচাবিক্রিতেও পড়ে চরম ভাটা। ফলে অলস সময় পার করেন বিক্রয়কর্মীরা। সব মিলিয়ে একেবারে জরুরি ওষুধ ছাড়া খুব কমই ওষুধপত্র কিনেছেন সাধারণ মানুষ। যদিও আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার কারণে হাসপাতাল কেন্দ্রিক ফার্মেসিগুলোতে রমরমা ব্যবসা হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল সরেজমিন রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের এলাকা, শাহবাগ এবং বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে ফার্মেসির মালিক ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা জানান, দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারফিউর শিথিলতায় স্বস্তি ফিরলেও বেচাবিক্রি বাড়েনি। মানুষের মধ্যে এখনো কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে তাদের ব্যবসা নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। দোকানের কর্মচারী থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিষেবার খরচও রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে গত কয়েক দিনে ভালোই লোকসান হয়েছে বলেও জানান তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জ্বর, সর্দি, শরীর ও মাথাব্যথার জন্য দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধের অন্যতম নাপা সিরাপ। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই ওষুধের কোনো বিকল্প নেই। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এই নাপা সিরাপের দাম ছিল ১৮ টাকা। পরে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ওই বছরের ৩০ জুন এ সিরাপের দাম নির্ধারণ করে ২০ টাকা। কিন্তু বছর শেষে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দাম হয় ২৫ টাকা। আর ২০২৩ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি নাগাদ এক বোতল নাপা সিরাপের দাম দাঁড়ায় ৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এই সিরাপের দাম বেড়েছে ১৭ টাকা। শুধু এই নাপা সিরাপ নয়, ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশন, ভিটামিন ও অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা এবং হাঁপানিসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের দামও দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরে অন্তত দুইশ’ ওষুধের দাম ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ওষুধের দাম। আর ওষুধ ভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা খরচ যত হয়, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে ওষুধ কেনার পেছনে। গত কয়েক দশকে এ ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বর্তমানে ওষুধের পেছনে ব্যয়ের হার ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে খরচের ১০০ টাকার মধ্যে ৬৪ টাকাই ওষুধের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। কম সরকারি বরাদ্দ এবং সে বরাদ্দও ঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগই মানুষকে খরচ করতে হয় নিজের পকেট থেকে। যে কারণে মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছে। তবে গত এপ্রিল মাসে ওষুধের দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি আমদানি করা অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি বন্ধের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। মূলত এই নির্দেশনার পর থেকেই ওষুধের দাম কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ওষুধের বাজারে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মতো দেশের ওষুধের বাজারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি এবং অনেক চিকিৎসকের অসুস্থ মানসিকতা স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ নষ্ট করছে। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর কিংবা সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমাফিক ওষুধের দাম বাড়ায়। ফলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়েই চলেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে দরিদ্র, হতদরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে চলে যাবে এবং স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত হবে কাঙ্ক্ষিত সাধারণ মানুষ।
ঢাকার মিটফোর্ডের নিপা ড্রাগস ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী গোবিন্দ চন্দ্র সময়ের, প্রায় সময়ই কোনো না কোনো ওষুধের দাম বাড়ে। তবে আমার জানামতে, গত কয়েকদিনে কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। আর কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ এবং কারফিউর কারণে অনেক ব্যবসায়ী দোকানপাট খুলতে পারেনি। তেমন কেনাবেচাও হয়নি। কারণ দোকানে মানুষ না এলে বিক্রি করবোই বা কার কাছে। এখন পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ায় আশা করছি বিক্রি বাড়বে।
বংশালের কাজল ফার্মেসির দোকানি নীরব হোসেন বলেন, গত কয়েক দিনে বেচাকেনা একেবারেই কমে গেছে। এটি আমার জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। কারণ দোকানও খোলা যাচ্ছিল না। আমরা এখন স্বাভাবিক একটা পরিবেশ চাই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকার এক দোকানি বলেন, জীবনের চেয়ে ব্যবসা বড় নয়। দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এই অবস্থায় কি দোকান খোলা যায়! কিন্তু যারা রিস্ক নিয়ে ওই সময় দোকান খুলেছিল তারা ভালোই ব্যবসা করেছে। আমরা শুনেছি সংঘর্ষে আহত হয়ে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা মেডিকেলে এসেছিল। কিন্তু তখন ভয়ে বেশিরভাগ ওষুধের দোকানই বন্ধ ছিল।