ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই ফের পানিবন্দি লাখো মানুষ

* জুলাই মাসে তিন দফা বন্যা * মেরিন ড্রাইভে পাহাড় ধসে যান চলাচলে বিঘœ * ভূমি ধস, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট খাদ্য ও পানি সংকট * টেকনাফ সড়কে যানচলাচল বন্ধ

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও খাবার পানির সংকট। চলাচলের রাস্তা পানিতে ডুবে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন চকরিয়া, রামু, সদর ও উখিয়া উপজেলার বাসিন্দারা। গত জুলাই মাসে এবারসহ কক্সবাজারে তিন দফা বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ ভেঙে পানিতে ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাথমিক হিসাবে ২৫ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সরেজমিন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর ও উখিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের খামার। এছাড়া বন্যার কারণে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ গবাদিপশুসহ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বন্যার্তদের অনেকে গবাদিপশুসহ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।

সদরের মুক্তারকুল এলাকার ষাটোর্ধ্ব মাহমদুল হক জানান, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ডিঙি নৌকায় কাঁথাবালিশ, লাকড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, রান্নার জন্য কাটা তরকারিসহ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন। গতকাল রাত ১১ তার ঘরে পানি ওঠায় জিনিসপত্র নিয়ে দরগাহ এলাকার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার সদরের ৩০ গ্রাম, উখিয়ার ৫০, রামুর ২০, পেকয়ার ১৫ ও টেকনাফের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে কৃষি ফসল ও চিংড়ি ঘের। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার চকরিয়া, উখিয়া, রামু ও সদর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ১৩৫ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে এসব এলাকার দেড় লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে বাঁকখালী নদীর কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বাঁকখালীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজারে টানা ভারী বর্ষণ হচ্ছে। একই সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে নেমে আসছে। রামু উপজেলার একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেন, উপজেলার ফতেখাঁরকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, চাকমারকুল, রাজারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঁকখালীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতে বিভিন্ন গ্রামের সাঁকো ভেসে গেছে। ফলে স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করছেন। রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির যুবক রোনাদ বলেন, গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি ঘরে পানি উঠে পড়েছে। শুধু আমার বাড়িতে না আমার এলাকা উমখালীর সবার বাড়িতেই পানি উঠেছে। সন্ধ্যার আগেই কিছু জিনিস নিয়ে এলাকার অনেকে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্রসহ বাকি সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

সদরের পূর্ব মোক্তারকুল এলাকার বাসিন্দা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক আমিন বলেন, টানা বৃষ্টিতে এলাকার প্রতিটি বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। যাদের বাড়িতে গবাদিপশু রয়েছে; তারাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম ইমরুল কায়েস জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নে ২০ গ্রামের ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। যেখানে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছে। ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটাই পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।

জালিয়াপালং ইউনিয়নের এসএম ছৈয়দ আলম জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের ১, ২, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরো এলাকার মানুষ এখন পানিবন্দি। যেখানে ৫০টি গ্রামের ৫০ হাজারের অধিক মানুষ রয়েছে।

রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, ওই ইউনিয়নের ৫০ গ্রামের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাও পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। কক্সবাজার পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের শিক্ষক মোস্তফা সরওয়ার জানিয়েছেন, কুতুবদিয়া পাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাক পাড়া, নাজিরারটেকসহ ৮ গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এসব এলাকায় ১০ হাজারের বেশি পরিবার রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজার শহরের গোলদিঘীরপাড়, বৌদ্ধ মন্দির এলাকা, কলাতলী, সদর ইউনিয়নের ঝিলংজা ইউনিয়নের ২০টির বেশি গ্রাম। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন সড়ক উপ-সড়কে প্লাবিত হয়ে, একপর্যায়ে অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতেও ঢুকে পড়ে। এতে অনেক বাড়িঘরের আসবাবপত্র, দোকানের মালামাল নষ্ট হচ্ছে।

কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ. কে. এম তারিকুল আলম বলেন, জলাবদ্ধতা এই শহরে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই সমস্যা নির্মূলে পৌর মেয়রের নেতৃত্বে পৌর পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে নাল নর্দমা দখল করে নির্মিত স্থাপনা ধ্বংস করে পুনরায় উদ্ধারের কাজ শুরু করেছি।

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন টিপু সুলতান বলেন, ঝিলংজার দক্ষিণ খরুলিয়া, পূর্ব মোক্তার কুল, পশ্চিম মোক্তার কুল, মহুরি পাড়া, চান্দেরপাড়া, ঘাটপাড়া, কোনার পাড়া, নয়া পাড়াসহ বাঁকখালী নদীর তীরবর্তী এলাকার প্রায় ২০ গ্রামে বন্যার পানি ডুকে পড়েছে। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্ব প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।

কক্সবাজার আবহাওয়ার কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, টানা দুইদিনের বৃষ্টিতে জেলাতে ২৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী তিন দিনও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা আছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ভারি বর্ষণের কারণে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষকে সহযোগিতা করতে সব ধরনের কার্যক্রম চলছে। তবে, পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা উখিয়া উপজেলায়। যেখানে ৫টি ইউনিয়ন কমবেশি মানুষ পানিবন্দি।