ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সচিবালয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা ‘সরব’

চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের সরানো হবে
সচিবালয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা ‘সরব’

দেশের জনগণের ভোটাধিকার বঞ্চিত করে নামমাত্র জাতীয় নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। দীর্ঘ চাকরি জীবনে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করেছে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। কথিত তদন্ত প্রতিবেদনে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকেই বিষণ্ণতায় ভুগেছেন।

গতকাল বুধবার সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে গেছে সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চেহারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীর তৎপরতা দেখা গেছে। সচিবালয়ের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেও দেখা গেছে। ১৫তম ব্যাচের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদে বর্তমানে রয়েছেন। অথচ ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকেই সচিব হয়েছেন। একই অবস্থা ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভয়-শঙ্কায় সচিবালয়ে বহু কর্মকর্তা এলেও কাজ হয়নি। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে মুছে ফেলা হয়েছে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নাম। নামানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা শেখ হাসিনার ছবি। বিভিন্ন দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবিসহ অন্যান্য ব্যানার-ফেস্টুনও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে উপস্থিত এক কর্মকর্তা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার রোষানলে পড়ে প্রশাসনের বহু যোগ্য কর্মকর্তা পদোবঞ্চিত হয়েছেন। অনেক কর্মকর্তা বুকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ নিয়ে অবসরে চলে গেছেন। গত ১৫ বছরে সমাজের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। ফ্যাসিজম ও যত অনিয়ম সবই বিদ্যমান ছিল। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়- দেশের প্রধান নির্বাহী যিনি (শেখ হাসিনা) ছিলেন তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে ৩০ বছর ধরে চাকরি করছি। চাকরি জীবনে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ সবই আছে, এরপরও রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে পদোন্নতি দেয়নি সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এ আমলে সিভিল সার্ভিস সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিককরণ করা হয়েছে। জনপ্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা নিজেই প্রধান নির্বাহী দায়িত্বে ছিলেন। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) স্বাক্ষর শেখ হাসিনাকে করতে হয়েছে। জনপ্রশাসনে যত অপকর্ম হয়েছে সবই শেখ হাসিনা করেছেন। কারণ তিনি অনেক নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, যোগ্য মানুষকে বঞ্চিত করেছেন।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, জনতার মঞ্চে কর্মকর্তাদের যোগদানের মধ্য দিয়ে সিভিল সার্ভিসে রাজনীতিককরণের সূত্রপাত ঘটেছে। কারণ সরকারি কর্মকর্তা কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে যেতে পারেন না।

২২তম ব্যাচের বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উপ-পরিচালক মু. বিল্লাল হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে যোগ্যতা থাকার পরেও আমিসহ আমাদের ব্যাচের সাতজন পদোন্নতি পায়নি। অথচ আমাদের ব্যাচের অনেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

দীর্ঘদিন ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) থাকা কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মরত ও পদোন্নতি না পাওয়া ১৯ কর্মকর্তাকে গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং সিনিয়র সহকারী সচিব। এর মধ্যে আছেন ১১তম ব্যাচের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপ-পরিচালক ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম, ১৩তম ব্যাচের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ১৫তম ব্যাচের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ও সিনিয়র সহকারী সচিব মো. বাবুল মিঞা। প্রশাসন ক্যাডারের ১১তম, ১৩তম ও ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বর্তমানে সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ এসব কর্মকর্তা গত সাড়ে ১৫ বছরে উপসচিবও হতে পারেননি। ১৭তম ব্যাচের ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুছ আলী, কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম তরিকুল আলম, পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুর রহমান তরফদার, ভূমি আপিল বোর্ডের শাখাপ্রধান কানিজ মওলা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সলিমুল্লাহ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফিরোজ সরকার, ১৮তম ব্যাচের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ফজলুর রহমান; ১৭ ও ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০তম ব্যাচের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) উপ-পরিচালক কে এম আলী আযম, ২২তম ব্যাচের বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উপ-পরিচালক মু. বিল্লাল হোসেন; ২০ ও ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২৪তম ব্যাচের বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরজাহান খানম, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের প্রেস কর্মকর্তা জসিম উদ্দীন, ভূমি আপিল বোর্ডের শাখাপ্রধান হোসনা আফরোজা ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম; ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির কাজ শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২৫তম ব্যাচের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফরিদা খানম ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সগীর হোসেন; ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা কয়েক বছর আগে উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চুক্তি বাতিল হবে শিগগিরই। যেসব জায়গায় পদোবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনসহ জনপ্রশাসনে বর্তমানে ১৮ জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সচিবালয়ে অবস্থিত একটি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকের স্বপ্ন থাকে এক দিন সচিব হবেন, বড় মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্? উদ্দিন চৌধুরী গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়গুলো শুনেছি। তাদের দাবি বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রশাসনের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে ফিরিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান জনপ্রশাসন সচিব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত