সেনা বেষ্টিত থানার কার্যক্রম শুরু হলেও কক্সবাজারের ৯ থানা ও পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে ফিরেনি বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য। ১১ দফা দাবি আদায়সহ নানাবিষয়ে ক্ষোভ থেকেই কর্মস্থলে ফিরছে না বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলার একাধিক পুলিশ পরিদর্শক, উপ-পরিদর্শকসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বেশিরভাগ থানা ও ফাঁড়িতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ছাড়া অন্য পুলিশ সদস্যদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। যারা কর্মস্থলে ফিরেছেন তাদের মধ্যে অনেকের মাঝে চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। গতকাল শনিবার সরেজমিন জেলার কয়েকটি থানা ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে এই তথ্য ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে অনেকেই তাদের ঘোষিত দাবি আদায় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। হাসিনার পতনের পর ১৫ বছর ধরে সুবিধাভোগী কিছু পুলিশ কর্মকর্তা তাদের খোলস পাল্টাতে শুরু করেছে। অনেকেই হাসিনার কর্মকাণ্ড নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা বয়ান লিখেছেন।
গতকাল একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিনিয়র কর্মকর্তারা এসিরুমে বসে নির্দেশনা দেন। তা পালন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয় মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের। তাঁবেদারির খোলস থেকে বের হতে চায় বেশিরভাগই পুলিশ। শুধু থানা, ফাঁড়ির পুলিশ নয়, কক্সবাজার জেলার ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও মাঠে কাজ করতে দেখা যায়নি। গত কয়েদিন ধরে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যানযট নিরসনে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া কক্সবাজার আদালতের নানা কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও পুলিশের ইউনিটগুলোর কার্যক্রমে অনেকটা স্থবির। যার কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। গতকাল সকালে রামু থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার মূল ফটকি বন্ধ রয়েছে। ছোট গেট দিয়ে ডুকে দেখা গেছে, থানার ভেতরে কেউ নেই। পরে কয়েকদফা রামু থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরকারি নাম্বারে যোগাযোগ করে সাড়া মিলেনি। তবে ওই থানার কর্মরত একজন জানিয়েছেন, ওসি স্যার শুক্রবার বিকালে থেকে অফিস করেছেন। তবে থানার অন্য সদস্যরা আসেনি। একই চিত্র দেখা গেছে, কক্সবাজার সদর মডেল থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হাজির থাকলেও অন্য অফিসাররা আসেননি। এমনকি থানার সেন্ট্রিও আসেনি। বাইরে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা ডিউটি করতে দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মছিউর রহমান বলেন, থানায় কর্মরত সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সব কিছুই দুয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি পুলিশ সদস্যরা থানায় না আসলেও সবাই জেলা শহরেই আছেন বলে দাবি করেন। মুঠোফোনে জেলার অন্য থানায় পুলিশের উপস্থিতি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে উপজেলার বিভিন্ন সূত্র মতে, অন্য থানাগুলোতে ওসি ছাড়াও সাদা পোশাকে কিছু সংখ্যাক পুলিশ সদস্যদের দেখা গেছে। তবে ঈদগাহ থানায় কোন পুলিশ আসেননি। ওখানেও সেনা ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
যোগদান করা কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, তাদের এখনও ভয় কাটছে না। আসার পথে কেউ হামলা করে কি না, সে ভয়ও তাড়া করেছে। এ জন্য সিভিল পোশাকে অফিসে আসতে হলো। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনও ভাবতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের।
পুলিশ লাইনের প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান, কিছু কিছু কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসে অবস্থান করছেন। বেশিরভাগ এখনও আসেননি। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে কথা হয় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, থানায় এবং দপ্তরে শুক্রবার বিকাল থেকে সীমিত পরিসরে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা তার নিজ নিজ কর্মে যোগ দিচ্ছেন। কক্সবাজার সদর মডেল থানা, ঈদগাহ থানা, জেলা ট্রাফিক অফিসসহ পুলিশের যেসব স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটেছে সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার আরো বলেন, শনিবার রাত ৮টায় জেলায় কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যদের উপস্থিত থাকার জন্য রোল কল আহবান করা হয়েছে। তখন বলা যাবে কতো পুলিশ সদস্য অনুপস্থিত রয়েছে।
কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো আমরা ফাইনালী রিপোর্ট তৈরি করিনি। এজন্য এ মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সদর ও ঈদগাহ থানার ভবনটি শুধুই দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাপ্ততথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় থানাসহ বিভিন্ন দপ্তরে ১ হাজার ৪১৪ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে। এর মধ্য পুলিশ সুপার একজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পাঁচজন, সহকারী পুলিশ সুপার ৩ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৬১ জন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ১৬৫ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ১৪০ জন ও কনস্টেবল ১০৩৯ জন।
পুলিশের তথ্য মতে, গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরে বিক্ষুব্ধ জনতা জেলার বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ বক্সে একযোগে হামলা ও লুটপাট চালায়। এই সময় আহত হয়েছেন অন্তত ১০০ জন পুলিশ সদস্য।
উপ-পরিদর্শক (এসআই) দস্তগীর হোসেন ৫ আগস্ট এর পর থেকে তার ফেসবুক ওয়ালে কয়েকটি স্ট্যাটাস লিখেছেন। একটিতে বলেছেন, সকল হত্যার পেছনে মূলহোতাদের গ্রেপ্তারসহ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের দাবি না মানলে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেব। নিহতের পুলিশ সদস্যদের একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন তিনি। ওখানে বলেছেন, একটাও বিসিএস ক্যাডারের লাশ নাই, সবই জুনিয়র অফিসারদের লাশ। সর্বশেষ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার চাই। আমরা জনগণের পুলিশ হয়ে ফিরতে চাই। সকল হত্যার বিচার চাই।
রবিউল করিম সিকদার নামের এক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) তার ওয়ালে লিখেছেন, স্বাধীন নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠন করতে রাষ্ট্রকর্তাদের এত ভয় কেন? আসলে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই পুলিশকে জনগণের বিপক্ষে ব্যবহার করে সুবিধা নিতে চায়? বিঃদ্রঃ যদি হয় সংস্কার, তবেই হবে পুলিশ জনতার। এছাড়াও তিনি এক পুলিশ পরিদর্শকের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মেজবাহ উদ্দিন নামের পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন তার ওয়ালে লিখেছেন, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে সবার সমান মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
কক্সবাজারে ক্ষতবিক্ষত ভবনে পুলিশের কার্যক্রম শুরুর প্রচেষ্টা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে ৫ আগস্ট। এদিন বিকালে আনন্দ মিছিলের পাশাপাশি দুর্বৃত্তরা সরকারি-বেসরকারি নানা ভবনে লুটপাট চালায়। সেই হামলায় আক্রান্ত হয় কক্সবাজার সদর থানা কার্যালয় ও কম্পাউন্ড। লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় থানা কম্পাউন্ডে থাকা কয়েকশ’ মোটর সাইকেল, পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ভেঙে ক্ষতবিক্ষত করা হয় ভবনের জানালার গ্লাসসহ সিসিটিভি ও অন্যান্য বিদ্যুৎ সংযোগও। এরপর হতে অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় কক্সবাজার সদর থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম। তবে, পরেরদিন হতে সেনাবাহিনীর টহলটিম থানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাহারা বসায়।
এরই মাঝে ৮ আগস্ট রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেছে। এরপর শুক্রবার (৯ আগস্ট) বিকালে থানায় বন্ধ থাকা কার্যক্রম সচল করার চেষ্টা চালিয়েছে সেনাবাহিনী।
কক্সবাজারে মাঠে দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল তানভীর হোসেন থানা কম্পাউন্ডে গণমাধ্যমকে ব্রিফিংকালে বলেছেন, আইনিসেবা পেতে আগের মতো সাধারণ জনগণ কক্সবাজার মডেল থানায় আসতে পারবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে গত ৫ আগস্ট হতে বন্ধ থাকা কার্যক্রম আমরা সচল করতে চেষ্টা করছি। এখন থেকে মানুষ থানায় সেবা পাবেন। পুলিশ, আনসার এবং সেনা বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিতভাবে থানায় দায়িত্ব পালন করছেন।
এসব মালামালের বিষয়ে তানভীন বলেন, এরইমধ্যে বেশ কিছু গাড়ি, মালামাল উদ্ধার করে শিক্ষার্থীরা ফেরত এনেছেন। এটা শতভাগ শিক্ষার্থীদের অধিনে হচ্ছে। এরা লুট করা মালামাল উদ্ধার করে সেনাবাহিনী দিচ্ছে। সেনাবাহিনী পুলিশকে হস্তান্তর করছে। শিক্ষার্থীদের আহ্বানে অনেকেই লুট করা মালামাল ফেরতও দিচ্ছে। তিনি এসব মালামাল ফেরত দেয়ার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি রকিবুজ্জামান বলেন, আইজিপি মহোদয় সকলকে কাজে যোগদান করতে বলেছেন। যোগদান করেছেন। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। সবকিছু এখনো এলোমেলো। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, চেয়ার, টেবিল সবকিছু ভাঙাচোরা। এজন্য থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের অনেকে যোগদান করতে পারছে না।
তিনি বলেন, কার্যালয়ে আপাতত পুলিশ সদস্য ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সবাইকে পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশ করতে হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নাম জানাতে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) জানায়, সরকারি কোয়ার্টারের থাকা ১১টি পরিবারের সবকিছু ভেঙে তচনছ করে ফেলেছে। এমনকি ব্যবহারের লুঙ্গিটা পর্যন্ত বাদ যায়নি। কক্সবাজারের দায়িত্বরত আনসার বাহিনীর ইনচার্জ সাইদুর রহমান বলেন, বুধবার দুপুর থেকে দায়িত্ব পালন করছি। থানার পুলিশ সদস্যরা এসে আবার চলে যায়। কারণ ভেতরে বসার মতো পরিস্থিতি নেই। এখনো সবকিছু অগোছালো। পুলিশের ১১ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। পুলিশ কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের অধীনে কাজ করবে না, পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের জনগণের সেবা তথা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত থাকবে।সারাদিনে ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করানো যাবে না। অধঃস্তন কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো অবৈধ বা মৌখিক আদেশ পালন করতে পারবেন না। অধঃস্তন কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতির মত পন্থা অবলম্বন করতে হবে।