কোটাবিরোধী আন্দোল, কারফিউ এবং পরবর্তী সরকার পতনের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা। এতে করে পর্যটক না আসায় স্থবির হয়ে পড়ে কক্সবাজার পর্যটন শিল্প।
তবে চলতি সাপ্তহ থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন। সৈকতের বেলাভূমিতে আসতে শুরু করেছে সমুদ্রপ্রেমী দর্শনার্থীরা। হামলা, ভাঙচুর ও লুটের ক্ষত মুছে খুলছে দোকানপাট, গতি ফিরছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। নিরাপত্তা নিয়ে গত শুক্রবার বিকাল হতে প্রতিদিন সেনাবাহিনীর দেয়া ব্রিফিংয়ের পর ধীরে সবকিছুর স্বাভাবিকতা আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল সোমবার বিকালে সৈকতের বেলাভূমিতে গিয়ে দেয়া যায়, কিছু দর্শণার্থী সমুদ্রপাড়ে অবস্থান করে ঢেউ উপভোগ করছেন। এদের অধিকাংশই স্থানীয়, জেলা ও চট্টগ্রামের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। পরিবারের সদস্যদের অবষাদ কাটাতে সৈকত এলাকায় এনেছেন তারা। গত রোববারও একই পরিমাণ লোকজন এখানে এসেছিলেন বলে দাবি করেছেন সৈকত এলাকার ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হাসেম সিকদার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ত্যাগের পর কিছু চিহ্নিত দুর্বৃত্ত হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট ভাঙচুর ও চাঁদাবাজি করেছে। গত ৯ আগস্ট হতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কক্সবাজার সদর থানা, পর্যটন জোনে এসে নিরাপত্তার বিষয়ে ব্রিফিং করেন। কোথাও কোন ধরনের অনিরাপদ কিছু দেখলে তাদের জানালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন। দুর্বৃত্তদের অপকর্ম না এড়ালে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়ার পর বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিরাপদ পরিবেশ ফিরছে। ফলে, কক্সবাজারের বেলাভূমিতে সমুদ্র দর্শণার্থী আসা শুরু করেছে। এদের মাঝে কিছু পর্যটকও রয়েছেন। তবে, তা উল্লেখ করার মতো নয়।
সরকার পতনের পর থেকে শহরের সড়কগুলোতে শিক্ষার্থীরা যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। অপসারণ করেছে ময়লা-আবর্জনাও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে হাটবাজারে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালায় শিক্ষার্থীরা। বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে শহরের প্রতিটি বাজারে মূল্যতালিকা টাঙানো হয়। তবে, গতকাল সোমবার সকাল কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাপিক পুলিশের কার্যক্রম লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে সোমবারও শিক্ষার্থীরা বাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে মাইকিং করে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন- প্রভাবশালী যেই হোক, কাউকে আপনারা চাঁদা দেবেন না। মাছ-মাংস, সবজির অতিরিক্ত মূল্য নেবেন না। একজনের জায়গা আরেকজন দখল করবেন না। আপনাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা রয়েছেন, আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সার্কিট হাউস সড়কের দেয়ালে বিভিন্ন স্লোগান লিখেছেন শিক্ষার্থীরা। শহরের আভ্যন্তরীণ ও বাস টার্মিনাল এবং লিংকরোড বাজারে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা মূল্যতালিকা টাঙিয়েছেন। থানায় আনসার সদস্যের নিয়ে নিরাপত্তা দিচ্ছেন সেনা সদস্যরা।
সেনাবাহিনীর পক্ষে কক্সবাজারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল তানভীর হোসেন টহলটিম নিয়ে অলিগলি ঘুরছেন। এ সময় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন, কক্সবাজারের সকল থানার কার্যক্রম ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। জনগণকে সেবাদানে কাজ শুরু করেছে থানা পুলিশ। তাদের সাথে রয়েছে আনসার সদস্যরাও। সার্বিক নিরাপত্তায় রয়েছে সেনা সদস্যরা।
এর আগে শনিবার (১০ আগস্ট) জেলার ছয় থানা ভবন পরিদর্শন করেন রামুর সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন, জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান, পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাকিবুজ্জামানসহ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার সদর থানা কম্পাউন্ড এলাকায় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সকল থানার কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে। তবে পুলিশের পুরোপুরি সেবা সচল করতে কিছু সময় লাগবে। এর জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, থানায় কিছু আসবারপত্র, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম লুট হয়েছে। সেনা বাহিনীর পক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই কক্সবাজারের সকল থানার কার্যক্রমের গতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন তিনি। সকলের সহযোগিতায় কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, কক্সবাজার একটি সম্প্রীতিময় জেলা এবং এলাকার লোকজন শান্তি প্রিয়। কক্সবাজারে স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। উন্মুক্ত রয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। আগত পর্যটকরা অতীতের মতো নিরাপদে সমুদ্র ও প্রকৃতি উপভোগ করতে পারবেন। যেতে পারেন যেকোনো জায়গা। সেনাবাহিনীর পক্ষ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। তিনি ব্যবসায়ীদেরও সব সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল সোমবার কক্সবাজারের ৯টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িগুলোর কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। ট্রাফিক পুলিশ আগের মতো রাস্তায় নেমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোনো কিছুতে আতঙ্কিত না হয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য ছাত্র জনতার প্রতি অনুরোধ জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত: ৫ আগস্ট বিকালে কক্সবাজারে থানা, ট্যুরিস্ট ও ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। গাড়ি ও আসবাবপত্র লুট করা হয়েছে। ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে চারটি হোটেলেও। লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয় অর্ধশতাধিক দোকান ও কয়েকটি বাসভবনে। এছাড়া বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনায় কক্সবাজারে সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গত কয়েকদিন ধরে সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।