দাম বাড়লেও বোরো ধানে লোকসান গুনছে কৃষক। চলতি বোরো মৌসুমে গতবারের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ দাম বেড়েছে। জাতভেদে প্রতি মণ ধানের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। তারপরও লোকসান গুনছে কৃষক। মূলত কৃষিজ উপকরণ সার, কীটনাশক, শ্রমিক খরচ, সেচ ও অনান্য খরচ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় এই লোকসানে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি বিভাগ এবং কৃষকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর প্রতি বিঘা জমিতে গত বছরের চেয়ে সার প্রয়োগে এক হাজার টাকা, কীটনাশকে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, শ্রমিক খরচ এক থেকে তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। গত বছর প্রতি বস্তা সারের দাম ছিল ৮০০ টাকা। এবার তা বেড়ে ইউরিয়া সার ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। পটাশ সার ৭০০ থেকে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকা। প্রতি বিঘা ধানে কীটনাশক স্প্রে করতে খরচ হয়েছিল দুই থেকে চার হাজার টাকা। বর্তমানে খরচ হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য বাড়তি খরচ তো আছেই। আবার অনেক জেলায় বিঘাপ্রতি ফলন দুই থেকে চার মণ কম হয়েছে। গত বছর প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার টাকার নিচে ছিল। তখন ফলন ভালো হওয়ায় মুনাফা করতে পেরেছিলেন কৃষক। চলতি বছর ধানের দাম এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খরচ বাড়ার সঙ্গে ফলন কম হওয়ায় লোকসানে পড়েছেন কৃষক।
সূত্র জানায়, এবার বোরো ধান চাষ করে বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন চুক্তিতে জমি চাষ করা কৃষকরা। সব খরচের পাশাপাশি বর্গাচাষিদের এবার বিঘাপ্রতি বাড়তি প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মূলত সার, কীটনাশক ও সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় উচ্চমূল্যে জমি চুক্তি নিয়ে চাষ করা বর্গাচাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ বছর বোরো মৌসুমে অনেক স্থানেই বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। পাশাপাশি পোকার আক্রমণও বেশি ছিল। দাবদাহে বেশি সেচ দিতে হয়েছে। ফলে আগের বছর যেখানে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছিল ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা, এ বছর খরচ হয়েছে বিঘাপ্রতি ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। সেচ ও শ্রমিক খরচ বেশি হওয়ায় এই বাড়তি খরচ হয়েছে। গত বছর ধানের দর ছিল প্রতি মণ গড়ে ৮৫০ টাকা। ফলন হয়েছিল গড়ে প্রতি বিঘায় ২৭ মণ। ওই হিসেবে প্রতি বিঘা জমির ধান বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার টাকা। এ বছর ধানের দাম প্রায় দেড়শ‘ টাকা বেড়েছে। কিন্তু এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে ধান পাওয়া গেছে ২৫ মণের কম। ফলে ধানের দাম বাড়লেও লাভ হয়েছে খুব কম।
সূত্র আরো জানায়, নওগাঁ জেলার বৃহত্তর ধান বেচাকেনার হাট মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌরিতে মানভেদে প্রতি মণ ব্রি-ধান২৮ জাতের ধান এক হাজার ১১০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা, সুভলতা ১ হাজার ১৮০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, জিরাশাইল ১ হাজার ২৪০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং কাটারিভোগ ১ হাজার ২৯০ থেকে ১ হাজার ৩১০ টাকা দরে বেচাকেনা হয়। অথচ এই ধান মৌসুমের শুরুতে বেচাকেনা হয়েছে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা কম দামে। প্রতি মণ ব্রি-ধান২৮ ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০ টাকা, সুভলতা ১ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া জিরাশাইল ১ হাজার ১৮০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা এবং কাটারিভোগ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে কৃষকের কাছে ধানের মজুত প্রায় শেষ। ফলে বাজারে ধানের দাম বাড়ছে। তবে মৌসুমের শুরুতে সরকারিভাবে ন্যায্য দামে ধান সংগ্রহ করা গেলে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হতেন। কিন্তু সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে গতি না থাকায় চলতি মৌসুমে পাঁচ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত ৭ মে থেকে শুরু হয়েছে ধান সংগ্রহ, শেষ হবে ৩১ আগস্ট। জুন মাস শেষে মোট ধানের মাত্র ৩০ শতাংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, যদিও ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে বর্তমানে ধানের মজুত খুবই কম। মজুত যা রয়েছে সব ব্যবসায়ী ও মিলারদের কাছে। এ কারণে সরকারি সংগ্রহের সুফল কৃষকরা পাচ্ছেন না।
এদিকে কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মতে, ভরা মৌসুমেও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে চার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিক ও আড়তদাররা। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও বন্যার অজুহাতে তারা এই খরচ বাড়িয়েছেন; যার নেতিবাচক প্রভাব শিগগিরই রাজধানীর বাজারে পড়তে যাচ্ছে। এ কারণে বাজারে এখন থেকে অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। সরকার মোটা চাল সংগ্রহের পাশাপাশি সরু চাল কেনা শুরু করলে বাজারের এই অস্থিরতা কমবে। সেই সঙ্গে ধান-চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যও সফল হবে। মূলত মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে দেন। কারণ ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ ও অনান্য খরচ মেটানোর চাপ থাকে। ফলে বাজারে কম দামে তারা ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু ওই সময়টায় যদি সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রম গতিশীল থাকে, তাহলে কৃষক কিছুটা উপকৃত হন। সেটি না হওয়ায় গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। সরকার একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে ন্যূনতম লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। উল্টো তারা মিলার ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করছে। দেশে কয়েক কোটি টন ধান উৎপাদিত হলেও সংগ্রহ হয় মাত্র পাঁচ লাখ টন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার ধান দিতে গিয়ে বহু রকম হয়রানির শিকার হন কৃষক। এ কারণে কৃষকের ক্ষেত থেকেই ধান সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। পাশাপাশি চাল সংগ্রহ কমিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম আরো বাড়াতে হবে। সরকারের খাদ্যগুদাম ৫০ লাখ টনে উন্নীত করতে হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপর সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, বর্তমানে বোরোর ভরা মৌসুম চলছে। বাজারে ধানের সরবরাহে সংকট নেই। এই সময় চালের দাম বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম দু-তিন টাকা বেড়েছে। কারণ এখনো জেলার বেশির ভাগ চালকল বোরো মৌসুমের ধান থেকে চাল উৎপাদন শুরু করেনি। মোকামে চালের সরবরাহ সংকটের কারণে বর্তমানে বেশি দামে চাল বেচাকেনা হচ্ছে। চালকলগুলো পুরোপুরি চালু হলে দ্রুত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।