পছন্দের লোকদের ভালো জায়গায় পোস্টিংসহ সবকিছুতেই সিন্ডিকেট তৈরি রেখেছে কক্সবাজার জেলা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। যার কারণে, জুনিয়র কর্মকর্তাদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ভেতরের খবর, অনেকটা ‘তুষের আগুন’ জ্বলার মতো ক্ষোভ বঞ্চিতদের মাঝে। এদিকে এতোদিনের কাজের অমূল্যায়ন, পছন্দের লোকদের পদায়নসহ নানা অনিয়ম নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, কর্মকর্তাদের অনুগত না হলে মা-বাবা ধরে গালমন্দ করেন। অনৈতিক নির্দেশ না মানলে বিএনপি-জামায়াত তকমা দিয়ে হেনস্তা করা হতো। অনেকটা নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কব্জায় কক্সবাজার জেলা পুলিশের সব কার্যক্রম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি তুলছিল বঞ্চিত পুলিশ সদস্যরা। তবে এতে কোনো ধরনের সুরাহা হয়নি। অনুসন্ধান বলছে, এই সিন্ডিকেটের বলয়ের লোক হওয়ায় বদলির পরও কক্সবাজারে বহাল তবিয়তে আছেন কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কবির। একটি বাহিনীর প্রধানের সুপারিশে বদলি হলেও তার ‘পাহাড়ে’ যেতে হয়নি। অন্য একজন পুলিশ পরিদর্শকের বদলির দুই বছরেই কক্সবাজারে বহাল তবিয়তে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে জানতে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে ওসি গোলাম কবির দাবি করেন, পূর্বের আদেশটি বাতিল করে তাকে নতুন করে কুতুবদিয়ায় পোস্টিং দিয়েছেন। অপরদিকে তার দাবি মতে, নতুন অর্ডারের কাগজটি নানা চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এক কর্মকর্তা জানান, এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে এমপি-মন্ত্রীদের সুপারিশে পোস্টিং পাওয়া ওসিরা। এর মধ্যে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকান্ত ভট্টাচার্য আ জ ম নাসির উদ্দিনের অনুসারী। নাসিরের আশীর্বাদেই মহেশখালী থানায় পোস্টিং হয় সুকান্তর।
একইভাবে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত মো. রকিবুজ্জামান সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান (সদস্য অবসরপ্রাপ্ত) সিন্ডিকেটের লোক। গোপালগঞ্জের বাসিন্দা হওয়ায় তার হাত অনেক লম্বা। এমনকি তিনি পোস্টিং বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার আশীর্বাদে পেকুয়া থানায় পোস্টিং পান মোহাম্মদ ইলিয়াস, শেখ হেলাল উদ্দিনের আশীর্বাদে রামু থানায় রয়েছেন ওসি মো. আবু তাহের দেওয়ানসহ অনেকেই। এছাড়া কক্সবাজারে বিভিন্ন ফাঁড়ি ও থানায় পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) এর বলয়ের লোকজন রয়েছে। তাদের অনুগত না হওয়ার কারণে কক্সবাজার জেলা পুলিশে যোগদান করেও পোস্টিং না পেয়ে চলে গেছে অনেকেই। এমনকি কয়েকজন পুলিশ পরিদর্শকের বিষয়ে বিএনপি -জামায়াতের লোক আখ্যা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদনও দিয়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, বর্তমান জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবির) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদকে তার কার্যক্রমে দুর্বলতা, প্রশাসনিক কাজে অদক্ষতাসহ নানা অভিযোগে চকরিয়া থানা থেকে তিন মাস ১৬ দিনের মাথায় প্রত্যাহার করা হয়। প্রত্যাহার আদেশের বিধিমতে, তাকে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করার নিয়ম থাকলেও বলয়ের আশীর্বাদে নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে ডিবির মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পদায়ন করা হয়েছে। তার ছায়া হিসাবেও ছিল আ জ ম নাছির উদ্দিন। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগে টিআই (প্রশাসন) পদায়নে। এসপির আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তিনজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) তুহিন আহমেদকে অঘোষিতভাবে টিআই প্রশাসনে পদায়ন করা হয়েছে। তবে নিয়ম ভঙ্গ করে তুহিনকে পদায়ন করা হলেও অফিসিয়াল কোনো কাগজ তাকে দেয়া হয়নি। সব সিনিয়র, জুনিয়রদের উপস্থিতিতে পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) পদে তাকে পদায়ন করেন এসপি। দীর্ঘদিন ধরে এসপির আশীর্বাদে টিআই তুহিন আহমেদ কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগকে জিম্মি করে রেখেছে। অতিমাত্রায় ঘুষ বাণিজ্যের কারণে গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর বিক্ষুব্ধরা ভুক্তভোগী ট্রাফিক অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় তার কক্ষটি যেনো অঘোষিত টর্চার সেল। পুলিশ পরিদর্শক থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত তার এই টর্চারসেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন শিকার হয়।
শুধু তাই নয়, তার মুখের ভাষাও গ্রামের রাখাল বালকের মতো। কথা কথায় বিএনপি-জামায়াতের তকমা, মা-বাবা ধরে গালমন্দ তার নিত্যদিনের ঘটনা। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি থানায় তার নিয়োগকৃত দালাল (পুলিশ) রয়েছে। তাদের মাধ্যমে নানা খবর সংগ্রহ করে পুলিশ পরিদর্শক থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের মানসিক জালে ফেলে অর্থ আদায় করেন তিনি। তার এসব ঘটনা বণর্না দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই।
অভিযোগকারী নাম না বলার শর্তে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, এই সিন্ডিকেটের নানা অনিয়মের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে ভয়ে ‘অজ্ঞাত’ অভিযোগ দেয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। কারণ পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেটটি অতিরিক্ত আইজিপি সাবেক এসবি প্রধান (অবসরপ্রাপ্ত) মনিরুল ইসলামের আস্থাভাজন ছিল। যার কারণে অভিযোগ দেয়ার পরও কোনো কাজের কাজ হয়নি। অনুসন্ধান মতে, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সিকিউরিটি সেলের একটি টিম বিষয়টি তদন্ত করলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এমন অভিযোগ উঠেছে, কোনো পুলিশ পরিদর্শক বা (এসআই) (এএসআই) দের প্রতি ক্ষিপ্ত হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাকিল আহমেদ ওই থানা এলাকার টাউট টাইপের কোনো লোকজনকে দিয়ে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করান। পরে ওই কর্মকর্তাকে ডেকে এনে মানসিক টর্চার করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে শাকিল সাধারণ মানুষের কাছে ভালো অফিসার হিসাবে পরিচিত। সূত্র বলছে, পদায়নের আগে পুলিশ সুপারের নিকট হাজির হওয়ার কথা থাকলেও প্রথমে হাজির হতে হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) মো. রফিকুল ইসলামের নিকট। তিনি বিভিন্ন প্রশ্ন করে নামের পাশে স্টার মার্ক করে এসপির নিকট পাঠান। অনেক সময় এসপি আবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শাকিল আহমেদের নিকট পাঠান। এভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশ সদস্যদের। দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ইঙ্গিত পেলেই পদায়ন করেন এসপি। কনস্টেবল পদায়নের দায়িত্ব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) মো. রফিকুল ইসলামের। তাকে নিয়েও রয়েছে মাঠে নানা কথা। কক্সবাজার শহরের আলোচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে রফিক তার বদলি বাণিজ্যসহ নানা কাজ করে থাকেন। ওই ব্যক্তি এডিশনাল এসপি রফিকুল ইসলামকে তার বন্ধু, ব্যবসায়িক পার্টনার বলে দাবি করেন। তাকে প্রায় সময় তার কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়।
অভিযোগে প্রকাশ, এডিশনাল এসপি রফিকুল ইসলাম আস্থাভাজন লোক দিয়ে পুলিশের অভ্যন্তরীণ টেন্ডার কাজ নিয়ে নিজেই কাজ করান এবং ভাগ নেন। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকদের বিরোধীয় জায়গা বায়না করে পরে চড়া দামে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। তার বিভিন্ন অনুসারী দিয়ে হোটেল-মোটেল জোন থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ ক্রয় কমিটিও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন রফিক। রামু থানার সীমান্তবর্তী এলাকা গর্জনিয়া থেকেও এসপি অফিসের নামে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। এছাড়া কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) এসএম শাকিল হাসান এডিশনাল এসপি রফিকুল ইসলামের আশকারায় বেপরোয়া। তার বিরুদ্ধে মামলা, ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত মামলা নিয়েও বাণিজ্যের শেষ নেই। গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের দিন বিক্ষুব্ধ ভুক্তভোগী লোকজন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে। ওই রাত থেকে শাকিল জনরোষ থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে রয়েছে। গত মঙ্গলবার পুলিশের অভ্যন্তরীণ গ্রুপে সহকর্মীদের কাছে দোয়া চেয়ে একটি বার্তা দিয়েছেন। এছাড়া তাকে রাঙামাটি বদলির একটি গুঞ্জনও উঠেছে। এরইমধ্যে শাকিল হাসান আদায়কৃত ঘুষ ফেরত দেয়ারও খবর পাওয়া গেছে।
তবে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রকিবুজ্জামান শাকিল হাসান এক সপ্তাহের ছুটিতে রয়েছে বলে দাবি করেন। অভিযুক্ত পরিদর্শক শাকিলের সরকারি ও ব্যক্তিগত নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি। পরে প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপ এ ‘আমার মাথায় অপারেশন হয়েছে। হাসপাতালে আছি, ক্লিয়ার কথা বলতে পারছি না। বলে একটি বার্তা দেন।’