এনআইডি ইসিতে রাখতে সিইসিকে স্মারকলিপি

স্বরাষ্ট্রে এনআইডি স্থানান্তর আইন বাতিল চায় কর্মকর্তারা

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষাসেবা বিভাগে ন্যস্ত করতে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩’ করে শেখ হাসিনা সরকার। এই আইনটি তৈরির শুরু থেকে বা এনআইডি স্বরাষ্ট্রে স্থানান্তরে সবসময়ই বিরোধিতা করেছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করে এবং স্মারকলিপি দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা ইসি সচিবের তোপ এবং শাস্তির মুখেও পড়েছেন কর্মকর্তারা। তারপরও নিজেদের হাতে জন্ম নেয়া এনআইডির ভাগ ছাড়তে চাননি তারা। এবার এনআইডি কার্যক্রম সুরক্ষাসেবা বিভাগে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩’ বাতিল সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও এনআইডির প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি সিইসিকে দেয়া হয়।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শাসনামলের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ফলস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবযাত্রা শুরু করেছে। আপনি অবগত আছেন যে, ২০০৭-০৮ সালে দল-মত নির্বিশেষে সবার আস্থার জায়গা থেকে আন্তজার্তিক মান অনুসরণ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপিসহ ৯টি আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার আর্থিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মহামান্য আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ নাগরিকের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে জাতীয়ভাবে ভোটার ডাটাবেইজ গড়ে তোলা হয়।

স্মারকলিপিতে আরো জানানো হয়, গত ২ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুসারে এই ডাটাবেইজে প্রায় ১২ কোটি ১৯ লাখ নাগরিকের তথ্য রয়েছে। ইউএনডিপির সমীক্ষা অনুসারে ভোটারদের এই সংগৃহীত ডাটা ৯৯.৭ শতাংশ সঠিক মর্মে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এই তথ্যের ভিত্তিতেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের একই জনবল দ্বারা গত ১৭ বছর ধরে নিবন্ধিত নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশব্যাপী নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে।

ইসি কর্মকতারা জানান, গত সরকার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপনীয় তথ্য যথেচ্ছ ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘রুলস অব বিজনেস’ সংশোধন করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ বাতিল করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হলেও বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর পক্ষে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত’ এবং ‘বিভিন্ন দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উক্ত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবে অপযুক্তি দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বহু দেশে নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, পুলিশ ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ এ দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে রোল মডেল হিসাবে বিবেচনা করে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রানাডা দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি দেশের নির্বাচন কমিশন সফলভাবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সাংবিধানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বিষয়ে স্মারকলিপিতে বলা হয়, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথা ভোটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যেই জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ণ করা হয়েছে মর্মে পরিগণিত হয়। কারণ উক্ত আইনে ধারা ১৫ এ বর্ণিত আছে যে (১) নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মোতাবেক নিবন্ধক প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রদান করিবে। (২) উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে নিবন্ধকের কার্যালয় এর অধীন একটি সেল থাকিবে। (৩) উক্ত সেলে নির্বাচন কমিশনের এক বা একাধিক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করিবে। এর মাধ্যমে কৌশলে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে যা প্রকারান্তরে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। এছাড়া আপনি জানেন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত দুটি ভিন্নধর্মী কাজ হলেও একই অর্থ, সময় ও জনবল দ্বারা একদিকে ভোটার তালিকা প্রস্তুত অন্যদিকে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানে নির্বাচন কমিশনের যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও অদ্যাবধি এর ধারাবাহিকতা সর্বস্তরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করা হলে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হবে এবং নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে।

তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন আরো জানায়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নাগরিকদের তথ্য সংরক্ষিত থাকায় কোনো তথ্য বিকৃতিসহ তথ্যের অপব্যবহারের সুযোগ কম। বর্তমানে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে ডাটাবেইজ ম্যানুপুলেট করার আশঙ্কা দেখা দিবে এবং বিদ্যমান চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বিনষ্ট হবে।

ইসির উপ-সচিব মোহাম্মদ মনির হোসে বলেন, আমাদের দাবিগুলো সিইসি আগে থেকে জানেন। এর আগেও তিনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার আমরা স্মারকলিপি দেয়ার পর তিনি বলেছেন, এটা যুক্তিক দাবি, আমি আমার দিক থেকে সব সহযোগিতা করবো।