কক্সবাজারে পুলিশি প্রহরায় নির্বিচারে গুলি

শনাক্ত হয়নি ‘অস্ত্রবাজ’

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র লালদিঘির পাড়ে পুলিশি প্রহরায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনার এক মাসের অধিক সময় পার হলেও এখনো শনাক্ত হয়নি ‘অস্ত্রবাজরা’। এমনকি সেদিনের ঘটনায় এ পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। পুলিশের উপস্থিতিতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে মামলা না করে উল্টো ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছে ভিডিও ফুটেজ। তবে তা নিয়ে লুকোচুরি খেলছে পুলিশ। এ নিয়ে জনমানুষের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে গুলিতে নিহত আহসান হাবিবের পিতা মো. হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে কক্সবাজার শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়া হয়। এরইমধ্যে আলোকিত বাংলাদেশের প্রতিবেদকের হাতে কয়েকটি ভিডিও এসেছে। এর মধ্যে যুবলীগ নেতা মারুফ হোসেন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। অপর একটি ভিডিতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা রুস্তম আলী চৌধুরী মিছিল থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। ওই মিছিলের ভিডিওতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সামনে, পেছনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আরো কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হেলমেট ও কালো টি-শার্ট পরিহিত যুবক ভারি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিলেও তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ১৮ জুলাই যখন মাগরিবের আজান শুরু হয়, তখন হেলমেট পরিহিত কিছু অস্ত্রধারী ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। একটি অজ্ঞাত অ্যাম্বুলেন্স করে অস্ত্র-গুলি আনা হয়। তাদের প্রশ্ন-গোলাবারুদ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি কার মালিকানাধীন?

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলমান আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই কক্সবাজারে বাসটার্মিনাল, লিংকরোড এলাকায় শাস্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হয়। ওইদিন বিক্ষোভ মিছিল শেষ করে ছাত্র-জনতা কক্সবাজার শহরের শহীদ মিনারে আসার চেষ্টা করে। তারা শহরের পেল্ট্রোল পাম্প অতিক্রম করার আগেই নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশের উপস্থিতিতে শত শত রাউন্ড গুলি চালান অস্ত্রবাজরা। এমনকি ওই সময় অস্ত্রবাজ চক্র উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরা, মুঠোফোনও অন করতে দেয়নি। ঘটনার সময় শহরের প্রধান সড়কের পৌরসভার লাইটগুলোও বন্ধ করে রাখেন অস্ত্রবাজরা। ওইদিন প্রায় রাতভর অন্ধকারে ছিল পুরো কক্সবাজার শহর। এ ঘটনার এক মাস অতিবাহিত হলেও এখনো মূল অপরাধী শনাক্ত হয়নি। পুলিশ ওই দিনের ঘটনা নিয়ে উল্টো অজ্ঞাতনামা দুইটি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও জাসদ নেতা বাদী হয়ে পৃথক ৫টি মামলা দায়ের করেন। ওইসব মামলায় প্রায় সাড়ে ১৭শ’ জন বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রদের আসামি করা হয়। এবং ছাত্র, বিএনপি-জামায়াতের ৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারের নামে গণ হয়রানি, বাণিজ্যের অভিযোগও অহরহ পুলিশের বিরুদ্ধে।

অন্য একটি সূত্র বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দায়েরকৃত সব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আহসান হাবিব কক্সবাজার শহরের লালদিঘির পূর্ব পাড়ের বিআরবি ক্যাবলস শোরুমের কর্মচারী। ঘটনার দিন সে শোরুমের দ্বিতীয় তলায় উঠে এবং মুঠোফোনে অস্ত্রবাজদের ছবি ধারণ করেন। ওই সময় অস্ত্রবাজরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। এতে সে গুলিবিদ্ধ হন। ওইদিন তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রামে নেয়ার পথে আহসান মারা যান। ময়নাতদন্ত ছাড়া তাকে দাফন করা হয়। পরে এ ঘটনা নিয়ে তার পিতা বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি অজ্ঞাত মামলা দায়ের করলে আদালতের নির্দেশে গত ১৯ আগস্ট তার লাশ উত্তোলন করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা, কক্সবাজার সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) প্রভোধ দাশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কক্সবাজার শহরের লালদিঘি পাড়ের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠানের একাধিক দায়িত্বশীল জানিয়েছে, গত ১৮ জুলাইয়ে ঘটনার পর কক্সবাজারে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদের নেতৃত্বে একদল সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধারণকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে যান এবং ডিভাইস থেকে মুছে দেন।

এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদ প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে সংযোগ বিছিন্ন করে দেন। পরে পুনরায় কল করা হলে ‘দুঃখিত ‘ এই মুহূর্তে কথা বলতে পারব না’ লিখে একটি ক্ষুদে বার্তা দেন তিনি। এদিকে কক্সবাজারের মতো এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি’র কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওসি জাবেদ মাহমুদের আগে কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় কর্মকালীন সময়ে তার মদদে আওয়ামী পেটুয়া বাহিনী লোকজন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর নামাজে জানাজায় প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করেন। এ নিয়ে খোদ সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারাও বিব্রত হন। তার এসব কারণে চকরিয়া থানা থেকে ৩ মাস ১৬ দিনের মাথায় তাকে প্রত্যাহার করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর জাবেদ মাহমুদ নিজেকে বিএনপি ঘরানার লোক দাবি করলেও গত ১৫ বছরে তার কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ব। তিনি নিজেকে কক্সবাজারের একজন আওয়ামী লীগ নেতার কলেজ জীবনের বন্ধু পরিচয় দিয়ে বেড়ান। ১৮ জুলাই কক্সবাজার শহরে কর্মরত ছিল এমন কয়েজন পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে কক্সবাজারের পরিবেশটা অনেকটা শান্ত ছিল। এমনকি মাঠ পুলিশের ভূমিকাও নমনীয় ছিল। তবে আয়নাঘরের ‘জনক’, গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’, ফোনকলে আঁড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ডের নায়ক সেই জিয়াউল আহসানের সহযোগী কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শাকিল আহমেদের কঠোরতার কারণে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মাঠ পুলিশের দাবি, আন্দোলন চলাকালে শাকিল আহমেদ নানা সময় ছাত্র -জনতার উপর গুলির নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে রাজি না হলে অনেক পুলিশ সদস্যদের বিএনপি-জামায়াতের তকমা দেন শাকিল। এমনকি ওয়াকিটকিতে গালমন্দের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের কর্মকালীন সময়ের পূর্বে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাকিল আহমেদ সেই জিয়াউল আহসানের সাথে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে দীর্ঘ সময় কর্মকালীন ছিলেন। ওই সময় থেকে শাকিল বেপরোয়া হয়ে ওঠে।