ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশে রীতিমতো পরিবর্তনের জোয়ার বইয়ে যাচ্ছে। এ যেন এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একের পর এক সুখবর বয়ে আনছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। যার শুরুটা করেছেন ক্রিকেটাররা। রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট জিতেছে টাইগাররা। ঐতিহাসিক সেই জয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার সুখবর দিলেন ফুটবলারা। নেপালে স্বাগতিকদের উড়িয়ে প্রথমবার সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার ললিতপুরের আনফা কমপ্লেক্সে নেপালকে ৪-১ গোলে হারিয়ে হয়েছে লাল সবুজের যুবারা। অথচ ঘরের মাঠে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল নেপালই। ম্যাচের শুরুটাও তারা করে ফেভারিটের মতোই! কিন্তু বাংলাদেশের গোলবারের নায়ক আসিফ হোসেন ও জয়ের নায়ক মিরাজুল ইসলাম মিলে ভেস্তে দেন স্বাগতিকদের পরিকল্পনা। মিরাজুল নিজে করেন জোড়া গোল, সতীর্থকে দিয়ে করান আরেকটি গোল। যোগ সময়ে শেষ পেরেকটি ঢুকে দেন পিয়াস আহমেদ। রেফারি জাফরান মোহাম্মদ শেষ বাঁশি বাজানোর পরেই টেন্টের ফুটবলাররা মাঠে ঢুকে পড়েন। মাঠে লাল সবুজের পতাকা বিছিয়ে কুর্ণিশ করলেন মিরাজুল, পিয়াস, সিয়ামরা। পতাকা গায়ে জড়িয়ে স্টেডিয়ামে লেপ অব অনার দিলেন যুবারা। ট্রফি উৎসর্গ করলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদদের প্রতি। বন্যার্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেও তাদের এই ট্রফি জয় বলে জানান কেউ কেউ। কোচ মারুফুল হক বলেন, ‘আলহামদুল্লিাহ, সব কৃতজ্ঞতা আল্লাহর। এই ট্রফি আমি জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করতে চাই। যারা নতুন এক বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন আমাদের। এই ট্রফি জয়ের সব কৃতিত্ব ছেলেদের। আমার কথামতো স্বাভাবিক খেলা খেলেই তারা জিতেছে। আমরা হাসি দেখতে চাই বন্যার্ত মানুষের মুখেও।’ ম্যান অব দ্য ম্যাচ মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পুরো ম্যাচটা খেলেছি আমাদের দেশের মানুষদের জন্য। দেশের মানুষদের আমরা ভালো দেখতে চাই। আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে চাই দেশের ফুটবল যেন এগিয়ে যায়।’ রাব্বি হোসেনের কথা, ‘এই জয়কে জুলাই মাসে শহীদদের জন্য উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার সেইসব দামাল ছেলেদের জন্যও যারা আহত হয়ে আজ বিছানায় কাতরাচ্ছেন। আমাদের এই ট্রফি শহীদদের এবং দেশের বন্যার্ত মানুষের প্রতি উৎসর্গ করলাম।’
নেপাল যাওয়ার আগে শিরোপা জেতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন কোচ মারুফুল হক। তার কঠোর পরিশ্রমে সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। গত বুধবার আনফা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৪-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে মিরাজুল দুটি এবং রাব্বি হোসেন ও পিয়াস আহমেদ একটি করে গোল করেন। নেপালের হয়ে এক গোল শোধ দেন সমীর তামাং। নেপালের বিপক্ষে প্রথম জয়, গ্রুপপর্বে হারের প্রতিশোধ এবং প্রথমবারের মতো সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়-এক ঢিলে তিন পাখি মেরে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশের যুবারা। সাউথ এশিয়ান গেমস ফুটবলে প্রথম স্বর্ণ, মেয়েদের সাফের একমাত্র শিরোপার পর এবার নেপালের মাটিতে অনূর্ধ্ব-২০ সাফে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। আনফা কমপ্লেক্সের পুরো স্টেডিয়ামজুড়েই ছিল নেপালের সমর্থন। ম্যাচে অবশ্য নেপালই বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে। বল পজেশন ও আক্রমণে স্বাগতিকরাই এগিয়ে ছিল। গোলের সুযোগও মিস করে কয়েকটি। বাংলাদেশ কাউন্টার অ্যাটাকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করে নেপালকে বধ করে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বাংলাদেশ ১-২ গোলে নেপালের কাছে হেরেছিল। সেই হারের মধুর প্রতিশোধ মিরাজুলরা নিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
ম্যাচের শুরু নির্ধারিত ৪৫ মিনিট শেষে রেফারি দুই মিনিট ইনজুরি সময় দেন। সেই ইনজুরি সময় বাংলাদেশ লিড নেয়। বক্সের বাইরে বাংলাদেশি ফরোয়ার্ড মিরাজুল ইসলামকে ফাউল করেন। রেফারি ফ্রি কিকের বাঁশি বাজান। বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শট নেন মিরাজুল। বাঁকানো শটে নেপালী গোলকিপার জিয়ারত শেখ সম্পূর্ণ পরাস্ত হন। সাইড পোস্টে লেগে বল বিপরীত দিকের জালে জড়ায় (১-০)। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে বাঁ দিক থেকে আসাদুলের ক্রসে আসাদ মোল্লার হেড গোলকিপারের সামনে ড্রপ খেয়ে বল যায় ফাঁকায় দাঁড়ানো মিরাজুলের সামনে। এবারও তিনি ভুল করেননি, হেডে বল জড়িয়ে দেন নেপালের জালে (২-০)। ৭১ মিনিটে আরো এক গোল বাংলাদেশের। এই গোলেও মিরাজুলের অবদান। তার বাড়ানো বলে রাব্বি হোসেন রাহুল গোল করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ৩-০ ব্যবধানে। ৮১ মিনিটে বাংলাদেশের রক্ষণ আর গোলকিপার মোহাম্মদ আসিফের ভুলে ব্যবধান কমায় স্বাগতিক নেপাল (৩-১)। তবে ইনজুরি সময়ের ছয় মিনিটে গোলের হালি পূরণ করে বাংলাদেশ। বাঁ দিক থেকে রাব্বি হোসেন রাহুলের ক্রসে পিয়াশ আহমেদ নোভা গোল করে ব্যবধান ৪-১ করেন। বিজয় উল্লাসে মাতে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।