বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার পরবর্তী শুনানি ১৩ সেপ্টেম্বর ধার্য করা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত নগর দায়রা আদালতের বিচারপতি শুভঙ্কর বিশ্বাস এই নির্দেশ দেন।
গতকাল শুক্রবার আনার হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কসাই জিহাদ হাওলাদারকে আদালতে তোলা হলে বিচারক শুভঙ্কর বিশ্বাস ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন।
এই হত্যার মামলার অভিযুক্ত সিয়াম হোসেনকেও এদিন আদালতে হাজির করার কথা ছিল। তার অসুস্থতার কারণে আদালতে তোলা হয়নি। তবে পরবর্তী শুনানির দিন দুজনকে একসঙ্গে হাজিরার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি শুভঙ্কর বিশ্বাস।
গত ১৬ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি মোট ১০১ জন সাক্ষী ও সাক্ষ্য প্রমাণের সহমতে ২৬৩ পৃষ্ঠায় প্রথম ৪ সিট আদালতে জমা দিয়েছিল।
জানা গেছে, চার্জশিটে কসাই জিহাদ হাওলাদার এবং সিয়ামের নাম রয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে চার্জশিটে কিছু বলা হয়নি। তদন্তকারী সংস্থার ব্যাখ্যা, তদন্ত শেষ না হলে খুনের কারণ বলা যাবে না। তদন্ত এখনো চলছে। তা ছাড়া এই মামলার মূল অভিযুক্তকে এখনো জেরা করা যায়নি।
এই ঘটনায় প্রথম গ্রেপ্তারের ৮৭ দিনের মাথায় এই চার্জশিট জমা পড়ে আদালতে। কারণ গত ২৩ মে কসাই জিহাদ হাওলাদারকে প্রথম গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে গত ৭ জুন ওই বনগাঁ থেকেই সিয়ামকেও গ্রেপ্তার করে সিআইডির কর্মকর্তারা। আদালতের নির্দেশে জিহাদ ও সিয়ামণ্ড উভয়ই রয়েছে দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কসাই জিহাদ হাওলাদার ও সিয়াম হোসেনকে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী, ৩৬৪,৩০২,২০১ এবং ১২০বি ধারায় এই চারটি মামলা দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটাই মামলা জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেয়া হয়েছে। ৩৬৪ অর্থাৎ হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ। ৩০২ অপরাধমূলক নরহত্যা। ২০১ তথ্য লোপাট, অর্থাৎ চক্রান্ত করে অস্ত্র ও দেহ প্ল্যান করে সরিয়ে ফেলা এবং ১২০ বি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করা (একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে)। অর্থাৎ এই মামলার সর্বোচ্চ রায় হিসেবে বিচারক আমৃত্যু যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে।
গত ২৩ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল বনগাঁর গোপালনগর থানার অন্তর্গত এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি জিহাদ হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে।
গত ২৩ মে এই জিহাদ হাওলাদার বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে পালানোর আগেই সিআইডি গোপন সূত্রে খবর পায় তার পর বনগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কসাই জিহাদ হাওলাদার নামে ২৪ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির বাড়ি বাংলাদেশের খুলনা জেলার অধীন দিঘোলিয়া থানার বারাকপুর গ্রামে। তার পিতার নাম জয়নাল হাওলাদার।
আনার হত্যার প্রায় দুই মাস আগে অভিযুক্তরা জিহাদকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। এর আগে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করে জিহাদ। জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে জিহাদ জানিয়েছিল, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই তিনি হত্যা করেছে। আরো চারজন বাংলাদেশি এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিল।
অন্যদিকে আনার হত্যা ঘটনায় গত ৭ জুন সিয়াম হোসেনকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল সিআইডি। তিনি বাংলাদেশের ভোলা জেলার বুরহাদ উদ্দিন গ্রামের আট নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
গত মে মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের তখনকার কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, আনার হত্যায় জড়িতদের একাধিক জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও খুনের মূল রহস্য এখনো জানতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে আসল কারণ জানা যাবে বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে, পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডির দেয়া তথ্যে বাংলাদেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন- আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া (৫৬), তানভীর ভূঁইয়া (৩০) ও সেলেস্টি রহমান (২২)। পরে মে মাসে যশোর থেকে সাইফুল আলম মোল্লা মেম্বার নামে আরেকজনকে আটক করে ডিবি। তিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খুলনার শিমুল ভূঁইয়ার সহযোগী বলে জানা যায়।
গত ১২ মে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসে আশ্চর্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান আনার। পরদিন ১৩ মে নিউটাউনের সঞ্জীবা আবাসনে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় বলে অভিযোগ।
এই খুনের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া কসাই জিহাদ ও সিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙ্গরের কৃষ্ণমাটি এলাকায় বাগজোলা খালে গিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। সেখান থেকেই উদ্ধার হয় মানুষের একাধিক হাড়গোড়।
জিজ্ঞাসাবাদে সিয়াম জানিয়েছিলেন, তিনি পলাতক আখতারুজ্জামান শাহিনের অধীনে ৬০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। শাহিনের নির্দেশেই তিনি জিহাদকে কলকাতা এনে রাজারহাটে ভাড়ার ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন। খুনের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র, প্লাস্টিক, টলি ব্যাগ সবকিছুই কিনে এনেছিল নিউমার্কেট এলাকা থেকে। অন্য দুই অভিযুক্ত ফয়সাল সাজি এবং মুস্তাফিজ রহমান মাংস কিমা করার মেশিন কিনে এনেছিল। আজিমকে কল করার পর তার মাংস এবং হাড় আলাদা করা হয় তারপর ছোট ছোট টুকরো এবং কিমা করা হয় ওই মেশিনে।
এরই মধ্যে গত ২৮ জুন সঞ্জীবা আবাসনের বিইউ-৫৬ ব্লকের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় প্রায় চার কেজি মাংস। উদ্ধারকৃত ওই মাংস মানুষের কি না তা পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছিল সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরীতে। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে ওই মাংস মানুষের।
কিন্তু সেই খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ এমপি আনারের কি না তা জানতে ডিএনএ পরীক্ষা করতে চায় তদন্তাকারী কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন এবং রক্তের সম্পর্ক থাকা অন্য ব্যক্তিদের ডেকে তাদের শরীরের নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলেও জানাই সিআইডি। ডরিনকে কলকাতায় আসার জন্য সিআইডির পক্ষ থেকে চিঠিও পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশের অশান্ত পরিস্থিতির কারণে এখনো পর্যন্ত কলকাতায় আসতে পারেনি ডোরিন।