চিড়ে চ্যাপ্টা নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি দিশাহারা হয়ে পড়েছিল লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ ভেবেছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু ১ মাস অতিক্রম হলেও এখনো দ্রব্যমূল্যের দাম তেমনটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিম্ন আয়ের মানুষরা কচ্ছব গতির আয়ের সঙ্গে খরগোশ গতির ব্যয় মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে মানবেতর জীবনযাপন অতিবাহিত করছেন তারা। কাজেই লাগামহীন নিত্যপণ্যের দামে নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকটা চিড়ে চ্যাপ্টা।

গত ৫ আগস্টের আগে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাল। গত একমাসে সেই চালের দাম কমেনি। বরং নতুন করে চালের দাম বাড়ার শঙ্কার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির চড়া দাম নিয়ে দারুণ বিপাকে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা বলছেন, নতুন সরকার অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমাতে যেমন উদ্যোগ নিচ্ছে, চালের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োজন। তারা বাজারে গিয়ে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।

এদিকে, পেঁয়াজ ও আলুতে শুল্ক কমিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও খুচরা বাজারে আগের সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। এর একদিন পরে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আগের মতো ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি আলুও আগের মতো ৬০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ডিমও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। মুরগির দাম মাঝে কিছুটা কমলেও আমার ঊর্ধ্বমুখী মুরগির দাম। তবে, কিছুটা স্থিতিশলি রয়েছে সবজির দাম। যদিও পাইকারি ও খুচরা বাজারে সবজির দামের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের কয়েক সপ্তাহের মতোই মোটা চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে আবার অধিকাংশ দোকানেই মিলছে না মোটা জাতের চাল। যে কারণে অনেক ক্রেতাকে বাধ্য হয়ে মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে।

এদিকে, মাঝারি চাল বিআর-২৮ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। পাশাপাশি মানভেদে সরু চালের কেজি ৭০ থেকে ৭৮ টাকা। মাস দেড়েক আগেও মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ ও মাঝারি চালের কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর সরু চাল বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭৬ টাকায়। অর্থাৎ, চালের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে বাজারে চাল কিনতে আসা একজন ক্রেতা বলেন, সংসারে প্রতিদিন দেড় কেজি চালের জন্য ১০০ টাকা লাগে। দাম কমছে না। দাম কমছে না। বরং বাড়ছে। এভাবে চলতে পারে না।

এদিকে, গত সপ্তাহে সবজির বাজারে প্রতি কেজি পটল বিক্রি হয়েছিল ৫০ টাকায়, শসা ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৪০ থেকে ৫০ টাকা, টমেটো ১৬০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, মূলা ৪০ টাকা, ঢেঁড়শ ৪০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই সপ্তাহে প্রায় কাঁকরোল, টমেটো, পেঁপের দাম দাম ৫ থেকে ১০ টাকা কমেছে। এছাড়া বাকি সবজির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। গত সপ্তাহে কাঁচা মরিচ ২৫০ টাকায় বিক্রি হলেও চলতি সপ্তাহে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য সবজির মতো বাজার ও রাস্তার পাশের ভ্যানে দামের তারতম্য রয়েছে।

বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়ে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে সোনালি মুরগির দামও। গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা হয়েছে সোনালি মুরগির দাম। ডজনে ৫ টাকা বেড়ে ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে গরু ও ছাগলের মাংসের দাম আগের অবস্থায়ই আছে।

গত বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক কমিয়েছে সরকার। তবে একদিনের ব্যবধানে এসব পণ্যের দামে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে এর প্রভাব পড়তে কিছুটা সময়েরও প্রয়োজন।

এ অবস্থায় গত সপ্তাহের মতো প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে, মৌসুমের মাঝামাঝি এসে বাজারে ইলিশের সরবরাহও বেশ বেড়েছে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি দাম। ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজির কিছুটা বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকায়। কমবেশি ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। আর ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেনা যাচ্ছে- ৯০০ থেকে ১১০০ টাকায়। ছোট ইলিশের কেজি ৬০০ টাকা।

রাজধানীর সবজির বাজারে নৈরাজ্যের অভিযোগ বেশ পুরোনো। তবে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সবজির দামের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ক্রেতাদের অভিযোগ থাকলেও সুরাহা মিলছে না।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পাইকারি সবজির আড়ত ও খুচরা বাজারের সঙ্গে সবজির দাম তুলনা করে দেখা যায়, পাইকারির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

খুচরা বাজারে সবচেয়ে কম দামি সবজির তালিকায় রয়েছে পেঁপে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। অথচ পাইকারি বাজারে সেই পেঁপে মাত্র ১৬ টাকা।

আড়ত ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি হিসেবে পেঁপে বিক্রি হচ্ছে বস্তা হিসেবে। বস্তায় যে কয় কেজিই থাকুক, ক্রেতাকে কিনতে হবে পুরোটাই এবং কেজি দরে। প্রতি কেজি ১৬ টাকা।

আবার খুচরা বাজারে যে লাউ ৮০ থেকে ১০০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, তা পাইকারি বাজারে মিলছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পিস দরে। আর একদিনের পুরোনো লাউ পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০ টাকায়।

কেজিতে কিনে ফালি হিসেবে বিক্রি করে খুচরা ব্যবসায়ীদের দ্বিগুণ মুনাফার পথ মিষ্টি কুমড়া। খুচরা বাজারে মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হয় ফালি হিসেবে। এক পিস কুমড়াকে ৬ টুকরা করে প্রতি পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। যার প্রতি টুকরার ওজন আধা কেজির কাছাকাছি। পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মিষ্টি কুমড়ার কেজিই ৩০ টাকা।

খুচরায় ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া কচুর লতি পাইকারি বাজারে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে কচুর লতি।

খুচরা বাজারে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া শশা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৮ টাকা কেজি দরে। এ বিষয়ে একজন খুচরা সবজি বিক্রেতা বলেন, আড়তের দামের পরেও তো আলাদা খরচ আছে। গাড়ি ভাড়া আছে। সেগুলোও তো হিসাব করা লাগবে।

এদিকে পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যে পার্থক্য কমে এসেছে কাঁচা মরিচের ক্ষেত্রে। খুচরা বাজারে এদিন ১৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে কাঁচা মরিচ। পাইকারি বাজারে তা ১২০ টাকা। এদিকে ৪ টাকা আটি দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে শাপলার লতা। যা খুচরা বাজার পর্যন্ত আসতে আসতে ১৫ টাকা আঁটি হয়ে যাচ্ছে। বাজার ভেদে ৪ টাকা আঁটির শাপলা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়।

জানামতে, গত বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ ও আলুতে শুল্ক কমিয়ে ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাবনা মোতাবেক এনবিআর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ১ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে পেঁয়াজ, আলু, সার ও কীটনাশকের ন্যায় নিত্যপণ্যের শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর কমাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে এনবিআরকে নির্দেশ দেন।

প্রজ্ঞাপনে আলুর আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে প্রযোজ্য ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া পেঁয়াজের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই সুবিধা বহাল থাকবে। আশা করা যায়, এসব নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক ও রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহারের ফলে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমে যাবে এবং ভোক্তাদের স্বস্তি দেবে।