শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালী আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা ও তার বাহিনীর লোকজন। গত ১৫ বছরে তার দাপট, বাহিনীর নির্যাতনের কথা বনর্ণা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুক্তভোগীরা।
তার নির্যাতনের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন দৃষ্টি হারানো মিনাহার বেগম ও মকসুদ, পঙ্গু হেলাল উদ্দীন। তাদের কান্নায় কক্সবাজার প্রেসক্লাবে হৃদয় বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ভুক্তভোগীদের পক্ষে আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ তুহিন বলেছেন, শরীফ বাদশা ইয়াবা চোরাচালানের সাথে জড়িত। প্যারাবন নিধন, ভূমিদস্যুতার সন্ত্রাসের গড়ফাদার তিনি। তার পুত্র জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নিশান, ভাই আবদুল গফুর, ফরিদ মিয়া ও মাওলানা নুরুল হক মিলে পুরো এলাকায় ১৫ বছর ধরে ত্রাসের রাজত্ব বানিয়ে রেখেছেন। নিজে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি।
তার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে চোখ, হাতসহ বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়েছেন কয়েকজন। তবুও কোনো ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি। দাপট ও টাকার বিনিময়ে থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গাঢাকা দিলেও শরীফ বাদশা ও তার সহযোগিরা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই এলাকায় ফিরতে পারছে না ভুক্তভোগীরা।
নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে কান্না করতে করতে ভেঙে পড়েন মিনহার বেগম নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার স্বামী শরীফ বাদশার বাহিনী আমাদের লবণ মাঠের জমি দখল করে। তারপরও সেখানে যাওয়ায় শরীফ বাদশা ও তার লোকজন আমার স্বামীর উপর হামলা করে। এসময় তাকে বাঁচাতে গেলে আমাকে তিন রাউন্ড গুলি করে শরীফ বাদশা। দুই রাউন্ড গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও এক রাউন্ড গায়ে লাগে। গুলিতে আমার দুই চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছে। গরিব হওয়ায় যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারিনি। এই ঘটনার কিছুদির পর তার স্বামী মোস্তাক আহমদকেও নির্মমভাবে আঘাত করা হয়। কিন্তু মহেশখালী থানা পুলিশ শরীফ বাদশার বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি।
এই ভুক্তভোগী জানান, আওয়ামী সরকারের পতন হলেও এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শরীফ বাদশা ও তার লোকজন। তাই এখনো বাড়ি যেতে পারেনি মিনহার বেগমের পরিবার। অর্থাভাবে তারা এখন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, ‘অন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিজের অনাগত সন্তান জন্ম নিলে আদরের সন্তানকে দেখতে পারবো না।
আরেক ভুক্তভোগী মকছুদ আহমদ বলেন, ‘আমাদের লবণ মাঠের জমি দখল করে শরীফ বাদশা ও তার লোকজন। এতে বাধা দিতে গেলে আমার উপর গুলি বর্ষণসহ নানাভাবে আঘাত করা হয়। এতে আমি চিরতরে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছি।
ভুক্তভোগী হেলাল উদ্দীন বলেন, শরীফ বাদশা ও তার লোকজন মিলে তাকে মারাত্মভাবে কোপায় এতে তার হাত চিরতরে পঙ্গু গেছে।
সম্প্রতি টেকনাফ থেকে একটি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বেলাল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার বেলাল আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ওই ভয়ংকর অস্ত্র শরীফ বাদশার জন্য আনা হয়েছিলো। এরপরও ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বাহাড়ছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইসমাইল হোসেন রহস্যজনক কারণে শরীফ বাদশাকে গ্রেপ্তার করছে না বলে জানান আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ তুহিন।
গত শনিবার ভুক্তভোগীরা শরীফ বাদশা ও তার সহযোগিতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। নির্যাতিতসহ অন্তত ২০ জন ভুক্তভোগী উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, এমন নৃশংসতা নির্যাতন করলেও কোনো ঘটনায় থানা পুলিশ শরীফ বাদশার বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি পুলিশ। উল্টো থানার ওসি তার পক্ষ হয়ে ভুক্তভোগীদের হুমকি দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা অস্ত্রসহ গ্রেতারকৃত বেলাল আদালতে জবানবন্দির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাহাড়ছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইসমাইল হোসেন অস্ত্রসহ গ্রেফতারকৃত বেলাল আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি তদন্তধীন রয়েছে। ওই মামলায় আরো কয়েজন আসামির এক দিনের রিমান্ড মনজুর করেছে আদালত। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর মূল কাহিনি কি জানা যাবে। এর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মহেশখালী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী তার (শরীফ বাদশার) বিরুদ্ধে কি মামলা আছে তা দেখে বলতে হবে। তবে নির্বাচনের আগে তদন্ত করে দেখছিলাম, তার বিরুদ্ধে বন আইনে একটি মামলা রয়েছে। আপনি তো তার হাতে নির্যাতিত লোকজনের মামলা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি দেখে বলতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, যা মন চায়, তা বলুক সমস্যা নেই।