মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে গত ৭০ এর দশক থেকে নানা সময়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা। এই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার তার দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তে স্রোতের মতো আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। এক মাসেই ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা আসে সেই দফায়। সব মিলিয়ে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে না বাংলাদেশ তৎপরতা চালালেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে বছরখানেক ধরে মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ; তাতে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন প্রদেশে জান্তা সরকারের বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত লেগেই আছে। বাংলাদেশেও যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকার পরিবর্তন ঘটল, তার সুযোগে দেশেরই দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের অর্থের বিনিময়ে ঢুকতে দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সীমান্তে বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নানা সর্তকতার পরও অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও কোস্ট গার্ডে জনবল কম থাকায় অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী। কোন দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা এদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করছে তাও তারা খতিয়ে দেখছেন বলে জানান উপজেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্যরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে বলে জানা যায়।
সীমান্তের বাসিন্দারা বলেন, সরকার পতনের পর কয়েকদিন সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালরা। তারা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে। সম্প্রতি তৎপরতা বাড়ানো হলেও সংঘবদ্ধ দালালরা রাতের আঁধারে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে মুখ্য ভূমিকা রাখছে।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘর্ষের কারণে শত শত রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিছু রোহিঙ্গা এরই মধ্যে এদেশে চলেও এসেছেন। কত সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তারা। তবে তারা ধারণা করছেন, ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।
উখিয়া কুতুপালং ১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন বলেন, রাখাইন রাজ্যে যেখানে (মংডুতে) হামলা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গার বসবাস। তারা নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
গত ৫ আগস্টের পরে নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গত রোববার (৮ আগস্ট) পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাতের আঁধারে টেকনাফের নাফনদী সীমান্ত দিয়ে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন। গত ১৫ দিনে ৫ থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে। এসব রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয়দের বাসা বাড়িতে অবস্থান নিতে না পারেন সে জন্য এলাকাবাসীকে সর্তক করা হয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষায় আরো কঠোর নজরধারীর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে কঠোরভাবে নজরধারী না রাখলে আবারো ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামতে পারে।
বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, সীমান্তে বিজিবির পক্ষে সর্বোচ্চ সর্তকর্তার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিজিবির অভিযানে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকপাচার ও অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪৩ জন চোরাচালানী এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক ও ২২ জন ভারতীয় নাগরিককে আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
টেকনাফ নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, নৌ পুলিশের ফাঁড়িতে বর্তমান কোন কর্মকর্তা নেই। মাত্র চারজন সদস্য স্টেশনে রয়েছেন। তাদের কোনো প্রকার জলযানও নেই। কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেলেও তাদের বাঁশি বাজানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের যে পরিস্থিতি তাতে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে জনবল তা দিয়ে শতভাগ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্পে অবস্থানকারি স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয়দের ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়ার তথ্য মিলেছে।
তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তা সঠিক। বিজিবি ও কোস্টগার্ডে বিপুল সংখ্যক জনবল না থাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ৯ হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। যেসমস্ত দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে সেসব দালালদের ব্যাপারে তথ্য নেয়া হচ্ছে।
সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য বলছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কম হলেও ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে। টেকনাফের বেশির ভাগ এলাকা জাদিমুড়া, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে দিয়ে এসব রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয় স্বজনের কাছে রয়েছে। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছে তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।