ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শ্রমিকদের অসন্তোষ

পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

বিকেএমইএ’র সভাপতি
পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ঢাকার গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় টানা কয়েক দিন ধরে পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এভাবে চললে পোশাক খাতে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হবে বলে মনে করছেন পোশাক কারখানার মালিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন বিদেশি ক্রেতারা, দিচ্ছেন না নতুন অর্ডার। সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। যথাসময়ে পণ্য শিপমেন্ট নিয়ে বাড়ছে চিন্তা। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে উৎপাদন শেষ করতে না পারলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এয়ার শিপমেন্টে খরচ কয়েক গুণ বাড়বে। চলমান অস্থিরতা সামাল দিতে না পারলে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এরইমধ্যে পোশাক শ্রমিকদের দাবি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবির সঙ্গে মিলে পুলিশ কাজ করছে।

জানা গেছে, পোশাক শ্রমিকরা প্রথমে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নামেন। পরে তারা চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দাবি জানান। পাশাপাশি তারা বেকারদের জন্য চাকরি ও কর্মচ্যুতদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি তোলেন। শ্রমিক নেতা ও মালিকপক্ষ তাদের সব দাবি যৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তারা মনে করছেন, যে ধরনের দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে তা সব পূরণযোগ্য নয়। কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও।

সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, এটা কোনো শ্রমিক আন্দোলন নয়। আমরা ইউনিয়ন করি, দাবি-দাওয়া পেশ করি এবং আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো আদায় করি। যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা যৌক্তিক নয়। বেতন বছর শেষে বাড়বে। আর হাজিরা বোনাস ৩০ দিন কাজ করলে পাবে। সেটা বড় কোনো দাবি নয়, এটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।

শিল্প পুলিশ জানায়, টঙ্গীতে ১৩ দফা দাবিতে ‘এমট্রানেট গ্রুপ লিমিটেড’ নামের কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন ‘পিনাকি গ্রুপ’, ‘ড্রেস ম্যান লিমিটেড’ ও ‘নোমান গ্রুপ’-এর শ্রমিকরা। কয়েক হাজার শ্রমিক অংশ নেন। বেলা আড়াইটার দিকে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দাবি মেনে নেয়। এরপরও এমট্রানেট গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. সুজন মিয়া, মো. সফিউল্লাহসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার পদত্যাগের দাবিতে তিনটা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা।

গাজীপুর সদর উপজেলার নতুন বাজার এলাকার এসএম নিটওয়্যার লিমিটেড ও অ্যাসরোটেক্স লিমিটেডের শ্রমিকরা পোশাক কারখানায় ঢুকে হাজিরা বোনাসসহ ১০ দফা দাবিতে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এসএম নিটওয়্যার ও অ্যাসরোটেক্স লিমিটেডের শ্রমিকরা অ্যাপারেলস-২১ লিমিটেড ও গ্রিন ফাইবার কম্পোজিট লিমিটেড কারখানার ফটকে গেলে ওই দুটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। বেলা একটার দিকে শ্রমিকরা যার যার অবস্থান থেকে সরে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

অন্যদিকে শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকার মেঘনা গ্রুপের হাই ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকরা ১৪ দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। এ সময় পাশের হাউ আর ইউ টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিকদের বের করে আনতে গেলে হামলার শিকার হন হাই ফ্যাশনের শ্রমিকরা। এ সময় উত্তেজিত শ্রমিকরা হাউ আর ইউ টেক্সটাইলে ঢুকে ভাঙচুর করেন। দুপুরে কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হলে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, মাঝে কয়েক দিন শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। হঠাৎ আবার বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন। সকাল থেকে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা নানা দাবি নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে ২৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করায় দুপুরের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি ও বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। এ সংকট দ্রুত সামাল দিতে না পারলে দেশের পুরো পোশাকশিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিক অসন্তোষে পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা, ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এ বিক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের সম্পর্কও নেই। তিনি আরো বলেন, রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিকনেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে।

বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টে দুটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করতে চক্রান্ত শুরু করেছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করতে চাচ্ছে। এ ধরনের দুর্বৃত্তদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে।

শ্রমিকনেতারা বলছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা তৈরি পোশাকশিল্পকে অস্থিতিশীল করতে ভাঙচুর চালাচ্ছে। শ্রমিক বিক্ষোভের আড়ালে তারা শিল্পকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ভাঙচুরে নিরীহ শ্রমিকরা জড়িত নন, বহিরাগতরাই এসব করছে। যেসব দাবির কথা বলা হচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে সেসব দাবির কথা শোনা যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত