এনআইডি স্বরাষ্ট্রে না নিতে রাষ্ট্রপতিকে ইসির চিঠি
এনআইডি নিয়ে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত আইনবহির্ভূত : ইসি সচিব
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিল করতে রাষ্ট্রপতির দপ্তরকে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব শফিউল আজিম।
গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি দপ্তরের জন বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির কাছে পত্রটি পাঠিয়েছেন তিনি।
জানা যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এনআইডি স্থানান্তরের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩’ বাতিল করে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম ইসি অধীনে রাখার জন্য রাষ্ট্রপতির দপ্তরকে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) পাঠানো হয়।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, আপনি অবগত আছেন যে, ২০০৭-০৮ সালে দলমত নির্বিশেষে সবার আস্থার জায়গা থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপিসহ নয়টি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ৮ দশমিক ১০ কোটি নাগরিকের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক জাতীয়ভাবে ভোটার ডাটাবেজ গড়ে তোলা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুসারে এ ডাটাবেজে প্রায় ১২ দশমিক ১৯ কোটি নাগরিকের তথ্য রয়েছে।
ইউএনডিপির সমীক্ষা অনুসারে ভোটারদের এই সংগৃহীত ডাটা ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ সঠিক মর্মে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের একই জনবল দ্বারা বিগত ১৭ বছর ধরে নিবন্ধিত নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশব্যাপী নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে।
তৎকালীন সরকার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপনীয় তথ্যসমৃদ্ধ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের মতামত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়েই নির্বাচন কমিশনের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। জানা যায়, এনআইডি কার্যক্রম স্থানান্তরে দ্বিমত জানিয়ে ০৭ জুন ২০২১ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পত্র পাঠিয়ে বিগত নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান সুস্পষ্ট করে বিগত সরকারের আমলে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ বাতিলপূর্বক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়। গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে উক্ত আইনটির কার্যকারিতার তারিখ নির্ধারিত না হওয়ায়, নির্বাচন কমিশনের অধীনেই বর্তমানে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ (১) অনুসারে ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে’। অন্যদিকে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এবং এতদসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসারে ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০২৩ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথা ভোটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে প্রণয়নের ক্ষেত্রে ডাটা প্রাপ্তির জন্য নির্বাচন কমিশনকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন নিয়োগকৃত নিবন্ধকে সংবিধানে প্রদত্ত নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন অস্তিত্বের পরিপন্থি।
এছাড়া আপনি জানেন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত দুটি ভিন্নধর্মী কাজ হলেও একই জনবল ও অর্থ দ্বারা একদিকে যেমন ভোটার তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের যুগোপযোগী উদ্যোগ, বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধানে ভোটার তালিকার উপজাত হিসেবে নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হচ্ছে, যা সর্বস্তরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলে ভোটার তালিকার তথ্য ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের অমিলের কারণে ভোট দেয়া বাধাগ্রস্ত হবে এবং নির্বাচন পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটবে। এছাড়া, তথ্যভাণ্ডারের শুদ্ধতা বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের তথ্যের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নাগরিকদের তথ্য সংরক্ষিত থাকায় কোনো তথ্য বিকৃতিসহ তথ্যের অপব্যবহারের সুযোগ কম। বর্তমানে সুরক্ষাসেবা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে ডাটাবেজ ম্যানিপুলেট করার আশঙ্কা দেখা দেবে এবং বিদ্যমান চেক ব্যালেন্স বিনষ্ট হবে।
শফিউল আজিম তার পত্রে আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রানাডা দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি দেশের নির্বাচন কমিশন সফলভাবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম সুরক্ষাসেবা বিভাগে ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করত: জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিলের বিষয়টি আপনার নজরে আনার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন) সদয় অনুমোদন দিয়েছেন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নাগরিকদের নিয়ে যেসব ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে তন্মধ্যে একমাত্র ভোটার তথা এনআইডি ডাটাবেজ ব্যতীত অন্য কোনো ডাটাবেজ শতভাগ আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যে কারণে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের পরিচিতি নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ডাটাবেজ ও নাগরিক সেবার ওপর আস্থাশীল, যা নির্বাচন কমিশনের এক অনন্য অর্জন। জাতীয় স্বার্থে অমূল্য এ তথ্যভান্ডারকে সুসংহত রেখে অব্যাহত নাগরিক সেবা নিশ্চিতকল্পে নির্বাচন কমিশন হতে জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করত: জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিলে সদয় পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আপনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।