ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে অচল কক্সবাজার

* পাহাড় ধস ও পানিতে ডুবে ৭ জনের মৃত্যু * ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল : একজন নিহত, ২২ জন উদ্ধার
রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে অচল কক্সবাজার

টানা ২৪ ঘণ্টার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে অচল হয়ে পড়েছে পুরো কক্সবাজার শহরসহ আশপাশের উপজেলাগুলো। এছাড়া পৃথক পাহাড় ধস ও পানিতে ডুবে শিশুসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরে ৩ জন, উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩ জন ও টেকনাফে পানিতে ডুবে একজন নিহত হয়। চলতি বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারে পাহাড় ধসে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজারের লাবনী পয়েন্টে এফবি রশিদা নামের একটি ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে একজন নিহত ও ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অপরদিকে গতকাল শুক্রবার সকালে মেরিন ড্রাইভ সড়কে পাহাড়ের কাদা-মাটি উপড়ে পড়ে যানচলাচল বন্ধ থাকলেও সেনাবাহিনীর একান্ত সহযোগিতায় বিকেল নাগাদ যানচলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানা গেছে। বলতে গেলে পুরো টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।

গতকাল কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা থেকে শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫০১ মিলিমিটার। চলতি ২০২৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এই বৃষ্টি আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধস ও পানিতে ডুবে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে পর্যটন শহরের ৯০ শতাংশ এলাকায় এখনও জলাবদ্ধতা রয়েছে। প্রধান সড়কসহ শহরের ৫০টি উপসড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। ওইসব এলাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করে নষ্ট হয়েছে মালামাল। বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল মোটেল এলাকার সকল সড়ক, সৈকতসংলগ্ন এলাকা, মাকের্টসমূহ ডুবে আছে পানিতে। কলাতলী সড়কের দুই পাশের পাঁচ শতাধিক হোটেল গেস্ট হাউসে যাতায়াতের ২০টি উপসড়কও ডুবে যায়। ফলে কয়েক হাজার পর্যটক হোটেলের কক্ষই বন্দি আছে।

শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদীঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাঁচা মিয়ার ঘোনা, পাহাড়তলী, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লারপাড়া এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে এই ওয়ার্ডের ১০ হাজার ঘরবাড়ি ডুবে যাবে। এই ওয়ার্ডে ৮০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। ডিককুলে পাহাড় ধ্বসে নিহতের স্বজন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুল করিম সিকদার জানান, রাত ২টার দিকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সময় মিজানের বাড়ির দিক থেকে একটি পাহাড় ধসের বিকট শব্দ শুনতে পায় তারা। পরে তারা গিয়ে দেখেন সপরিবারে মাটিচাপা পড়েছে মিজানের পরিবার। তাৎক্ষণিকভাবে মিজানকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। পরে আজ ভোর রাতের দিকে কক্সবাজার দমকল বাহিনীর সহযোগিতায় উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে স্ত্রী ও দুই শিশু মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন, দক্ষিণ ডিককুলের মিজানুর রহমানের স্ত্রী আখি মনি এবং তার দুই শিশুকন্যা মিহা জান্নাত নাঈমা ও লতিফা ইসলাম।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ট্রলার ডুবির ঘটনায় আহত ইউসুফ জানান, গত একসপ্তাহে আগে ২৩ জন জেলে গভীর সাগরে মাছ ধরতে যান। বিকল হয়ে তারা ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে। এতে একজন মারা যান। ১৯ জন কূলে ফিরে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বলেন, ভারী বৃষ্টিতে ক্যাম্প-১৪ তে পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলো- উখিয়ার পালংখালি ক্যাম্প ১৪ ই-২ ব্লকের বাসিন্দা আব্দুর রহিম, তার দুই শিশুর সন্তান আব্দুল হাফেজ (১০) ও আব্দুল ওয়াহাদ (৪)। কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণে হোটেল মোটেল জোন এখন পানিতে পানিতে সয়লাব। কলাতলী সড়ক, সকল উপসড়ক, সৈকতসংলগ্ন ছাতা মাকের্ট, হোটেল লাবণী থেকে সুগন্ধা এলাকায় এখন পানি আর পানি। এদিকে পাহাড় ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে কক্সবাজার সদরের ইউএনও নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী। ভারী বৃষ্টিতে টেকনাফ ও উখিয়ার অন্তত ৮০টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের ৬০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

টেকনাফ সদর, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, বাহারছাড়া ও সাবরাং ইউনিয়নের এসব গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উখিয়ার রাজাপালং, জালিয়াপালং, হলদিয়াপালং ও পালংখালী ইউনিয়নের আর ২০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা বলেন, টানা বর্ষণে কক্সবাজারের মাটি নরম হয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক স্পষ্টে পাহাড়ে ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, সকাল থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়কে পাহাড় ধসে যানচলাচল বন্ধ ছিল। বিকেলে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.আদনান চৌধুরী বলেন, উপজেলার হোয়াইক্ষ্যং এলাকায় আড়াই বছরের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। তার পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, পুরো উপজেলার মধ্যে কচ্ছপিয়া, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ও খুনিয়াপালং ইউনিয়নে কিছু অংশের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বৃষ্টি কমে গেলে তেমন সমস্যা হবে না। তবুও পুরো উপজেলার জনগণকে সুরক্ষায় সজাগ আছি’। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ঝিলংজায় পাহাড় ধসে নিহত তিনজনের পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কাজ চলছে। পানিবন্দি এলাকার তালিকা তৈরি, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার কাজ করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত: গত ১৯ জুন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক দিনে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২১ জুন কক্সবাজার শহরের বাদশাঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী নিহত হন। গত ৩ জুলাই উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের দুটি ক্যাম্পে পাহাড় ধসে দুজনের মৃত্যু হয়। ১১ জুলাই কক্সবাজার শহরে এক শিশু ও এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে ২৭ জনে মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগই উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ও সদর উপজেলায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত