রপ্তানি নেই তবুও কমছে না ইলিশের দাম
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
ভারতে রপ্তানি না করার সিদ্ধান্তের পর সামাজিকমাধ্যমে ইলিশে দাম কমার তথ্য দেখে সম্প্রতি বাজারে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশেরই জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যটির উচ্চমূল্য নিয়ে হতাশাও জানাচ্ছেন অনেকে। ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বাস্তবের মাছের বাজার সবখানেই ইলিশের দাম নিয়ে কৌতূহল চোখে পড়ার মতো। ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে বিক্রেতাদেরও। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ভারতে ইলিশ না পাঠানো ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের কথা জানিয়ে বলেন, আমরা ক্ষমা চাচ্ছি; কিন্তু আমরা ভারতে কোনো ইলিশ পাঠাতে পারব না। এটি দামি মাছ। আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের মানুষই ইলিশ খেতে পারে না। কারণ সব ভারতে পাঠানো হয়। তবে রপ্তানি না হওয়ার পরেও বাজারে মাছটির দাম নাগালের মধ্যে নেই বলে জানাচ্ছেন ক্রেতারা। ঢাকার হাতিরপুল বাজারে মাছ কিনতে আসা চাকরিজীবী নার্গিস বেগম বলেন, রপ্তানি বন্ধ; কিন্তু দাম তো কমে নাই, মাঝখান থেকে আমরা বাজারে এসে নাজেহাল হই। এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে, মৎস্য উপদেষ্টার ভাষায় ‘দামি মাছটি’র দাম কমছে না। যার অন্যতম, যোগানের ঘাটতি।
জেলের জালে ধরা পড়া ইলিশ তিন থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে আসে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এসব জায়গায় দামের তারতম্যের ওপর বাজারও ওঠানামা করে। চাঁদপুরের আড়তগুলোতে গত মঙ্গলবার সকালে ৩ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকার আশপাশে। অন্য মাছের মতো ইলিশের ক্ষেত্রেও ওজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দাম। অর্থাৎ, মাছের আকার যত বড় হয়, কেজিপ্রতি দামও তত বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া, সমুদ্র-মোহনা থেকে ধরা মাছ আর নদীর উজানের মাছের ক্ষেত্রেও দামে বেশ কিছুটা পার্থক্য থাকে বলেও জানান মাছ বিক্রেতারা। প্রায় এক কেজি ওজনের মাছের কেজিপ্রতি দাম উৎসে ১ হাজার থেকে ১১০০ টাকা। অর্থাৎ, জেলেরা প্রতি কেজি মাছের জন্য এই দাম পেয়ে থাকেন বলে জানান, ভোলার মেঘনা নদীর জে?লে ইব্রাহীম মা?ঝি। আড়তে ওই আকৃতির মাছের দাম ওঠে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। যা আরো ২০০-৩০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হয় ভোক্তাকে। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার বলেন, মঙ্গলবার সকালে এক কেজি ওজনের মাছের মণ বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ হাজার টাকা। রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের মাছের জন্য ১৮০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকছেন বিক্রেতারা। আবদুল বারী জমাদার জানান, কিছুদিন ধরে এই দামের মধ্যেই ইলিশের বেচাকেনা হচ্ছে।
যেসব কারণে দাম কমে না : দেশের ইলিশ রক্ষায় সরকার প্রতি বছর পহেলা মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২ মাসের মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপর মে-জুন থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইলিশ আহরণের মৌসুম। এই সময়টাকে ‘পিক টাইম’ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার এই সময়টায় মাছের দেখা মিলছে খুবই কম। ২০২২ সালে প্রতিদিন ১২০০ মণ ইলিশ আসতো আমাদের মোকামগুলোয়, গত বছর আসে ৭০০ থেকে ৮০০ মণ আর এইবার আসতেছে দুই-আড়াইশো মণ। এ বছর ৪০টি ট্রলারে দাদন (অগ্রিম অর্থ) দিয়েছেন জানিয়ে এখন পর্যন্ত একটি ট্রলার যথেষ্ট মাছ পায়নি বলে দাবি করেন তিনি। জানান, একেকটি ট্রলারে প্রায় ৫ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। এই দাদনদাতাদের মাধ্যমেই জেলেদের মাছ বিক্রির বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে কমিশন এজেন্ট হিসেবে তারা দশ শতাংশ অর্থ পান।
পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে দাম হ্রাসের সুযোগ থাকে না, এমনটাই জানাচ্ছেন অন্য ব্যবসায়ীরাও। আরেকটি কারণ, জেলে ও ট্রলারের খরচ তথা ব্যবসার বিনিয়োগ ও অন্যান্য ব্যয়। বেচা বিক্রির অনুপাতে খরচও কম নয়, বলছিলেন ভোলার আড়তদার মো. ইউনুছ মিয়া। তিনি বলেন, ১০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে ৬ হাজার টাকা খরচ করা লাগে। আবদুল বারী জমাদার জানান, আকৃতিভেদে একেকটি ট্রলার বানাতে ব্যয় হয় এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সেগুলো ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে। ফলে, ট্রলারের বিনিয়োগ তুলে আনতে গেলেও মাছের বেচা-বিক্রি ভালো দামে হওয়া জরুরি তাদের কাছে। এছাড়া, মাছের বাজারের উচ্চ দামের জন্য কেউ কেউ সিন্ডিকেটের অভিযোগও তুলে থাকেন। তবে, তা অস্বীকার করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
আবদুল বারী জমাদারের দাবি, আমরা উন্মুক্ত নিলামে মাছ বিক্রি করি। সিন্ডিকেটের কোনো সুযোগ নেই। জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়লে দাম নিজে থেকেই কিছুটা কমে আসবে বলে তার দাবি। বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এর বার্ষিক উৎপাদন ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।